সম্প্রীতির পীঠস্থান বর্ধমানের জৌগ্রাম

পূর্ব বর্ধমান জেলার একটি প্রাচীন জনপদ জৌগ্রাম। হাওড়া বর্ধমান কর্ড লাইনে জৌগ্রাম স্টেশন থেকে কিছুটা দূরেই এই প্রাচীন গ্রামটি অবস্থিত।এই গ্রামটির পূর্ব নাম যোগগ্রাম বলে অনেকে মনে করেন। দামোদর নদীর মরা খাতের তীরে এই গ্রামটি অবস্থিত। জামালপুরের কাছে একসময়ে দামোদর এর মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একটি শাখা দক্ষিণ পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়েছিল। অনেকের মতে এই শাখাটির নাম উছলবেলিয়া নদী। এই উছলবেলিয়া নদীর তীরেই জৌগ্রামের অবস্থান।
গ্রামে প্রবেশের পথে কয়েকশো বছরের পুরনো জলেশ্বর শিব মন্দির।অরণ্যে আচ্ছাদিত এই মন্দিরের মধ্যেই জলেশ্বর রূপী মহাদেব বিরাজ করছেন।পাশেই রয়েছে বিশাল মাঠ প্রতিবছর শিবরাত্রির দিন এখানে মেলা বসে প্রচুর জনসমাগম হয়।
মন্দিরটিতে প্রাচীন টেরাকোটা শিল্পের অদ্ভুত নিদর্শন চোখে পড়ে এবং স্থাপত্যশিল্পেও জৈন সংস্কৃতিরও মিলন ঘটেছে।
১৩৬১ সালে শিবরাম দত্ত কর্তৃক মন্দিরটি পুনঃসংস্কার করা হয়। লোহার গেট পেরিয়ে মন্দিরের মূল প্রবেশপথ সামনেই বিশাল মঞ্চ তারপরেই প্রধান মন্দির।


অনেক ইতিহাসবিদদের মতে এই জৌগ্রাম এলাকাতেই জৈন তীর্থঙ্কর মহাবীর বর্ধমান কৈবল্য সাধনায় সিদ্ধি লাভ করেন। জলেশ্বর শিব মন্দির এর সামনে একটি বড় বেল গাছ ছিল।কথিত আছে সেই বেল গাছের নীচেই মহাবীর সাধনা করেন। এই মহাবীর বর্ধমানের নাম অনুসারেই এখনকার বর্ধমান  শহর এর নাম করণ হয়।
এই গ্রামের একটু ভিতরে চাষা পাড়ায় আছে বদর সাহেবের সমাধি (বদর পীরের মাজার)। মাজার এর পাশেই বদরতলা দুর্গা মন্দির। হিন্দু জনবসতি পূর্ন গ্রাম হলেও বদর তলায় বদর সাহেব বহুদিন ধরে পূজিত হয়ে আসছেন।
বদর পীর কে সাধারণভাবে "জল পথের রক্ষাকর্তা" বলা হয়ে থাকে। বাংলাদেশের উপকূলবর্তী জেলার নাবিকেরা নৌ যাত্রার আগে বদর পীরের নাম উচ্চারণ করে হাল ধরতেন। অধুনা বাংলাদেশের চট্টগ্রামে বদর পীরের বিরাট মাজার রয়েছে। এই বদর পীরকে কেন "জলপথের রক্ষাকর্তা" বলা হয় তা নিয়ে বিভিন্ন মত পাওয়া যায়। তবে সাধারণভাবে যে ব্যাখ্যাটি সর্বজনগ্রাহ্য তা হল মাঝি মল্লারা বিপদে পড়লে বদর পীরকে স্মরণ করতেন। আগেই বলেছি জৌগ্রামের সাথে জলপথের যোগাযোগ ছিল।এবং সেই পথে বাণিজ্যিক আদান প্রদান হত।আর এই কারনেই এই অঞ্চলের বাসিন্দাদের বদর পীরের প্রতি নির্ভরতা জেগে উঠেছিল বলে ইতিহাসবিদদের একাংশ মনে করেন। আরেকটি জনশ্রুতি অনুসারে মধ্যযুগের কোনো এক সময় এক ফকির এই গ্রামে এসে সাধনা করতেন।গ্রামের হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিল।তাঁর মৃত্যুর পর এক মাজারটি গড়ে তোলা হয়। লোকমুখে একথা শোনা যায় যে পীর সাহেব এখানে এসেছিলেন তিনি ছিলেন অলৌকিক শক্তির অধিকারী। তিনি আজও সাদা ঘোড়ায় চেপে এই এলাকায় ঘুরে বেড়ান। তবে সেই ফকিরের নাম কি ছিল তিনিই আসলে বদর সাহেব ছিলেন নাকি অন্য কেউ তা জানার আর কোনো উপায় নেই। 
ঘটনা যায় হোকনা কেন বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে সম্প্রীতির যে বন্ধন তৈরী হয়েছে বদর সাহেবের পীরতলা কে কেন্দ্র করে তার স্মৃতি সৌধ হয়ত আজ জরাজীর্ণ কিন্তু হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির যে মূল বন্ধন এই মাজারকে কেন্দ্র করে তা আজও শক্ত কংক্রিটের ভিতের উপর মজবুত হয়ে আছে।



Post a Comment

0 Comments