বিষ্ণুপুরের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস (A Short History of Bishnupur)

 বিষ্ণুপুরের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

বিষ্ণুপুর ভ্রমণ

বিষ্ণুপুর, বাঁকুড়া জেলা আকর্ষণীয় জায়গা

বিষ্ণুপুর দর্শনীয় স্থান

আমরা চার বন্ধু মিলে বেড়িয়ে পড়লাম বাঁকুড়া ও পুরুলিয়ার উদ্দেশ্যে। আমরা যেহেতু বর্ধমান থেকে গিয়েছিলাম তাই আমাদের রুট ছিল এরকম- প্রথম দিন বর্ধমান থেকে বনলতা রিসোর্ট হয়ে বিষ্ণুপুর। পরের দিন বিষ্ণুপুর থেকে মুকুটমণিপুর হয়ে জয়চন্ডি পাহাড়। তৃতীয় দিন অযোধ্যা পাহাড়। প্রত্যেকটি জায়গার কথা তুলে ধরব আলাদা আলাদা রচনায়। আজকের আলোচনা বিষ্ণুপুর। 


বাঁকুড়া জেলার মহকুমা শহর বিষ্ণুপুর আদিতে 'বন বিষ্ণুপুর' নামে খ্যাত ছিল।বিষ্ণুপুরের প্রাচীন নাম মল্লভুম।এই মল্লভূম বা বন-বিষ্ণুপুর ছিল প্রাচীন মল্লভূম রাজ্যের রাজধানী।মল্ল রাজারা বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর বিষ্ণুর উপাসক ছিলেন বলে তার নাম অনুসারে মল্ল রাজাদের রাজধানির নামকরণ হয় বিষ্ণুপুর।মল্ল রাজ্যটি আজকের বাঁকুড়া, বর্ধমান, মেদিনীপুর, মুর্শিদাবাদের কিছু অংশ এবং বিহারের ছোটোনাগপুর অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। খ্রীষ্টীয় সপ্তম শতাব্দী থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ পর্যন্ত যাঁরা রাজত্ব করে গেছেন তাঁরা 'মল্লরাজ' নামে খ্যাত। (মল্ল অর্থাৎ কুস্তি) মল্ল কথাটির অর্থ বাহু যুদ্ধে নিপুণ এমন ব্যক্তি।


কিংবদন্তী এই যে, খ্রীষ্টীয় সপ্তম শতকের শেষের দিকে বৃন্দাবনের নিকটবর্তী জয়নগর রাজ্যের রাজ্যচ্যুত রাজা সস্ত্রীক তীর্থদর্শনের উদ্দেশ্যে পুরীধামের দিকে যাত্রা করেন। পথে কোতুলপুরের কাছাকাছি লাউগ্রামে রাজার সন্তানসম্ভবা স্ত্রী একটি পুত্র সন্তান প্রসব করেন। এই অবস্থায় রাজা তাঁর স্ত্রী ও সদ্যোজাত শিশুকে মনোহর পঞ্চানন নামে এক ব্রাহ্মণের কাছে গচ্ছিত রেখে একাই তীর্থের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। এই শিশুপুত্রটি গরীব ব্রাহ্মণের বাড়ীতে বড় হতে থাকে। একদিন ব্রাহ্মণ এক আশ্চর্য দৃশ্য দেখলেন। গরু চরাতে চরাতে ছেলেটি ক্লান্ত হয়ে মাঠের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে এবং তার মাথার কাছে এক বিরাট সাপ ফণা বিস্তার করে রোদকে আড়াল করে আছে। পঞ্চানন এই দৃশ্য দেখে বুঝতে পারলেন যে এই ছেলেটির মধ্যে রাজলক্ষণ রয়েছে। এরপর থেকে তিনি তার গরু চরানো বন্ধ করে অস্ত্রবিদ্যা ও শাস্ত্রচর্চার ব্যবস্থা করলেন। মাত্র ১৫ বৎসর বয়সেই সেই বালক এক দক্ষ মল্লবীর হয়ে উঠল। স্থানীয় রাজা তাকে 'মল্ল' উপাধিতে ভূষিত করলেন। একদিন ঐ রাজার অনুরোধে তিনি রাজসিংহাসনে বসলেন। ঐ বালক পুরুষ এরপর 'আদিমল্ল' বা 'রঘুনাথ' নামে বিখ্যাত হয়ে ওঠে। আদিমল্লের রাজধানী ছিল প্রদ্যুম্নপুরে (জয়পুরের কাছাকাছি)।


মল্লরাজ জগত্ মল্ল বিষ্ণুপুরে তাঁর রাজধানীটি স্থানান্তরিত করেন। রাজপরিচালনার সুবিধার জন্য বা মৃন্ময়ী মাতার আকাশবাণী পেয়ে মৃন্ময়ী মন্দির ও রাজদরবার প্রতিষ্ঠা করেন। জগৎত্মল্লের পর তেমন কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেনি রাজপরিবারের মধ্যে।


মল্লরাজ বীরহাম্বিরের রাজত্বকালে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে। যুবরাজ বীরহাম্বির পাঠান সর্দ্দার দায়ুদ খাঁকে যুদ্ধে পরাস্ত করেন। মহারাজা বীরহাম্বির পাঠানদের মেরুদণ্ড ভাঙতে মোঘলদের যথেষ্ট সহায়তা করেন। বীরহাম্বির শ্রীনিবাস আচার্যের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত হন। এরপর থেকে বিষ্ণুপুরে শুরু হয় এক নতুন ইতিহাস। মল্লরাজারা বিষ্ণুপুরে গড়ে তুললেন একের পর এক বিষ্ণু মন্দির, রাসমঞ্চের মত সৌধ। বীরহাম্বিরের পর এক একজন রাজা এক বা একাধিক মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এরপরই খনন করা হয় সাতটি বাঁধ (কৃষ্ণবাঁধ, শ্যামবাধ, লালবাঁধ, পোকাবাঁধ, গাঁতাতবাঁধ, কালিন্দীবাঁধ ও যমুনাবাঁধ)।


দ্বিতীয় রঘুনাথ সিংহের আমলে দিল্লীর সেনী ঘরানার সিদ্ধ পুরুষ বাহাদুর খাঁ-র আগমণের ফলেই পরবর্তীকালে ভারতবিখ্যাত 'বিষ্ণুপুর ঘরানা'-র জন্ম হয়েছিল।

দ্বিতীয় রঘুনাথ সিংহের সহোদর গোপাল সিংহের আমলে এ রাজ্যে প্রজাদের হরিনাম করা বাধ্যতামূলক ছিল। তাঁর সময়ে মারাঠারা বাংলা লুঠ করার সময় বিষ্ণুপুর আক্রমণ করেন। লোকশ্রুতি এ সময়েই মদনমোহন ঠাকুর দলমাদল কামান দেগেছিলেন মারাঠাদের বিরুদ্ধে। গোপাল সিংহের পুত্র চৈতন্য সিংহ মল্লভূমের উল্লেখযোগ্য রাজা ছিলেন।


বিষ্ণুপুরের দর্শনীয় স্থান

বিষ্ণুপুরের প্রাচীন মন্দির মৃন্ময়ী মন্দির। এটি ৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠা করেন জগত মল্ল। 

এছাড়া রাসমঞ্চ, শ্যামরায় মন্দির, জোড় বাংলা মন্দির, কালা চাঁদ মন্দির, রাধালাল জিউ মন্দির, মদন মোহন মন্দির, ছিন্ন মস্তা মন্দির, জোড় মন্দির, রাধা গোবিন্দ মন্দির, রাধামাধব মন্দির। মন্দির ছাড়া উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান গুলি হল- গুমগড়, বড় পাথর দরজা, ছোট পাথর দরজা, পাথরের রথ, লাল বাঁধ, দলমাদল কামান, লালগড়, লাল বাঈ মহল প্রভৃতি। 


Post a Comment

0 Comments