বেহুলা নদীর তীরে ঐতিহ্যবাহী গ্রাম- আমাদপুর
মেমারি থানার অন্তর্গত আমাদপুর একটি প্রাচীন ও বর্ধিষ্ণু গ্রাম। মেমারি রেল স্টেশন থেকে ৪ কিলমিটার উত্তর পশ্চিমে এই গ্রামের অবস্থিতি। মেমারি থেকে বাস, ট্রেকার বা টোটোতে করে গ্রামে পৌঁছানো যায়। সু প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় এবং রাধাকমল মুখোপাধ্যায় এর জন্মস্থান এই গ্রামে। উনবিংশ শতকে ব্যবসার ক্ষেত্রে বাঙালির স্বনির্ভরতার পরিচয় দিয়ে আদর্শ স্থাপন করেছিলেন এই গ্রামের মহেশ চন্দ্র চৌধুরি। তিনি বহু অর্থ ব্যয় করে গ্রামে আনন্দময়ীর মন্দির, অতিথিশালা, সুবৃহৎ জলাশয়, ইংরেজি বিদ্যালয় ও দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন করেছিলেন।
বর্ধমান জেলার দক্ষিণ পূর্বাংশের মধ্যে দিয়ে অত্যন্ত সর্পিল গতিতে বিভিন্ন শাখা প্রশাখায় প্রবাহিত হয়ে হুগলী জেলায় প্রবেশ করে ভাগীরথীর সাথে মিশেছে গাঙ্গুর- বেহুলা নদী। এই নদীকে কেন্দ্র করে মধ্যযুগে রচিত মঙ্গল কাব্যগুলি উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক উপাদান। সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ক্ষেমানন্দের মনসা মঙ্গলে বেহুলার নিরুদ্দেশ যাত্রাপথে এবং পরে চৌদ্দ ডিঙা সহ চম্পাইতে প্রত্যাবর্তনের পথে যে স্থান গুলি ( ওঝাটি, গোবিন্দপুর, বর্ধমান, গাঙ্গপুর, নেয়াদা, আমদপুর, হাসানহাটি, নারিকেলডাঙ্গা, বৈদপুর )র উল্লেখ পাওয়া যায় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি গ্রাম হল আমদপুর।
মঙ্গল কাব্য থেকে জানা যায় এই বেহুলা নদী ছিল বানিজ্যের প্রধান পথ। চাঁদ সদাগর এই নদীতেই বানিজ্যের ভেলা ভাসিয়ে ছিলেন।জনশ্রুতি আছে জিনিসপত্র আমদানি করা হত বলে গ্রামের নাম হয় আমাদপুর।শোনা যায় বহু পূর্বে এখানে জিনিস পত্র কেনা বেচার বিরাট বাজার ছিল।মুলত সাতগাছিয়া গঞ্জ থেকে কৃষিজাত দ্রব্য ,মাটির বাসন পত্র , জামা কাপড় ইত্যাদি এখানে আমদানি হত। সেই জন্য এই এলাকার মানুষজন এই জায়গাকে 'আমদানিপুর' নামে অভিহিত করত। পরবর্তীকালে এই আমদানিপুর আমাদপুর হিসেবে পরিচিতি পায়। আবার অনেকে বলেন এই গ্রামে অনেক আম গাছ ছিল বলে আমাদপুর নামকরণ হয়।
এই গ্রামের প্রধান উৎসব কালীপূজো। কথিত আছে গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা বেহুলা নদীর পাশে ছিল একটি শ্মশান। সেখানে বেশ কয়েকজন সাধক তন্ত্র সধনা করতেন। সেই থেকেই গ্রামে কালীপূজোর প্রচলন।
প্রায় ৫০০ বছর এর ও বেশী পুরনো এই কালীপূজো গুলো পরিচালনা করে গ্রামের বারোয়ারিগুলি। বড়মা, মেজমা, সেজমা নামে যে কালি পুজো গুলি প্রচলিত আছে তা সবই সাধনা হয় তন্ত্র মতে। আমাদপুর গ্রামে বড়মা, মেজমা, সেজমা ছাড়াও আরও প্রায় ৫০-৬০ টি কালি পুজো হয় গ্রামের বিভিন্ন পাড়া মিলে। ২দিন ধরে এই পুজো অনুষ্ঠিত হয়। ভাসান কে কেন্দ্র করে মানুষের উৎসাহ ও উদ্দীপনা জনপ্লাবনের রূপ নেয়। বাঁশের উপর মানুষের কাঁধে চেপে সমগ্র গ্রাম পরিক্রমা করে প্রতিমা নিরঞ্জন হয়। কোনরূপ যানবাহন ব্যবহৃত হয়না। আমাদপুর গ্রামে কালীপূজো ছাড়াও আরও কিছু উৎসব বেশ জনপ্রিয়। এর মধ্যে-
আমাদপুর গ্রামের পুরাকীর্তি-
গ্রামে ২০ টি টেরাকোটা অলঙ্করনে সজ্জিত প্রাচীন মন্দির আছে। তারমধ্যে গোপাল মন্দিরের প্রসিদ্ধি সর্বাধিক। মন্দিরটি নির্মিত হয় ১৫৭২ খ্রিস্টাব্দে। এই গ্রমের বিভিন্ন পরিবার ঐতিহ্যশালী মন্দির ও স্থাপত্য নির্মাণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেন।
👉গ্রামের নন্দী পরিবারের উদ্যোগে নির্মিত হয় একটি শিব মন্দির ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দে।
👉হালদার পরিবারের উদ্যোগে নির্মিত হয় শিবের আটচালা মন্দির( পঞ্চানন শিব মন্দির)।
👉চৌধুরি পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায় নির্মিত হয় আনন্দময়ীর মন্দির, পাশাপাশি দুটি আটচালা শিব মন্দির, রাধামাধবের দোল মঞ্চ।
👉নাথ পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায় নির্মিত হয় আটচালা শিব মন্দির(বুড়ো শিবের মন্দির)।
👉চক্রবর্তী পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায় নির্মিত হয় রেখা দেউল রীতিতে গোপালের মন্দির।
👉দাসনন্দী পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায় নির্মিত হয় জোড়বাংলা রীতিতে দামোদর মন্দির।
👉বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায় নির্মিত হয় মদন গোপাল মন্দির (১৭০০ খ্রিস্টাব্দ)।
এছাড়া রয়েছে মুখার্জি পরিবারের ঐতিহ্য মন্ডিত বিরাট বাড়ি। যা 'বাঘ বাড়ি' নামে পরিচিত।
এই বাড়িতেই ঐতিহাসিক রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। দরজার উপর প্রতিষ্ঠা লিপি থেকে জানা যায় বাড়িটি নির্মিত হয়েছিল ১২৯০ সালে।
এই গ্রামে আছে শ্রীমৎ ভোলানন্দ গিরির শিশ্য স্বামী সচ্চিদানন্দের আশ্রম। সচ্চিদানন্দের পূর্ব নাম ছিল ড ঃ দেবেন্দ্রনাথ মুখার্জি।
আমাদপুরের বাঘ বাড়ির কাহিনী 👈 Click here
বর্তমানে এই গ্রামে লোক সংখ্যা প্রায় সাত হাজার। গ্রামে মোট পাড়া রয়েছে ২০ টি। সপ্তাহান্তে বা উৎসবের সময় এখন এই গ্রামে চৌধুরী দের জমিদার বাড়িতে পর্যটকরা আসেন।
অনলাইনে বুকিং করার সুবিধা রয়েছে। গ্রামের পাশে বিশাল আমবাগান শীতকালে পিকনিকের জন্য আদর্শ জায়গা।
0 Comments