আজ
থেকে ১০০ বছর আগে এক সাধারণ গৃহ বধূর সাহিত্য প্রতিভা বাংলার সমাজজীবনে মুক্ত
চিন্তার যে প্লাবন ঘটিয়ে ছিল কজনই বা তার খবর রাখি?উনিশ শতকে বাংলা নবজাগরণের ঢেউ মুক্ত চিন্তার প্লাবন বয়ে আনলেও বঙ্কিমচন্দ্র-শরৎচন্দ্ররা যখন
বাঙালি মুসলমানদের চরিত্র চিত্রণে বিরত ছিলেন ঠিক তখনই শৈলবালা ঘোষজায়ার একটি উপন্যাস ‘শেখ আন্দু’
প্রবাসী পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে ছাপা হলে চারিদিকে হৈ চৈ পড়ে যায়।
মুসলমান ছেলের প্রেমে নিমজ্জিত বিধবা ব্রাহ্মণ মেয়ে জোৎস্না। শৈশবালাকে এজন্য
তিরস্কারের তীরে ক্ষত-বিক্ষত হতে হয়। সামলাতে হয় সমালোচনার ঝড়। শুধু তাই নয়
স্বেচ্ছানির্বাসিতও হতে হয়।
শৈলবালা
ঘোষজায়া (Shailabala Devi)যে-সময় ‘শেখ আন্দু’ উপন্যাসটি রচনা করেন, সে-সময় সমাজ ছিল খুব পশ্চাদপদ। হিন্দু-মুসলিম সকল সমাজেই তখন গোঁড়ামি ও অন্ধ বিশ্বাস ছিল
প্রবল। এই সময়ে শৈলবালা ঘোষজায়া মুসলিম সমাজের এক পুরুষ চরিত্র চিত্রণে যে ভুমিকা
রেখেছেন তা অনবদ্য ও অনন্য।
শৈলবালার জন্ম ইংরেজি ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দের ২ মার্চ। বাংলা ১৯ ফাল্গুন
১৩০০ সালে তাঁর পিতা কুঞ্জবিহারী নন্দীর তৎকালীন কর্মস্থল চট্টগ্রামের কক্সবাজারে।
পিতা ছিলেন একজন চিকিৎসক ―অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জেন।
মাতার নাম ছিল হেমাঙ্গিনী দেবী। কুঞ্জবিহারী ছিলেন শহর বর্ধমানের সন্তান― পুরাতন চকে ছিল তাঁর আবাস। সরকারী কর্ম থেকে অবসর গ্রহণ করে তিনি বর্ধমানে
এসেই বসবাস করতে শুরু করেন সপরিবারে। এখানের রাজ-বালিকা বিদ্যালয়ে শৈলবালাকে ভর্তি
করে দিলেন। অল্পকালের মধ্যেই শৈলবালা স্কুলে নিজেকে বুদ্ধিমতী বালিকা বলে পরিচয়
করিয়ে দিলেন। অসাধারণ বুদ্ধিমতী এই বালিকা বরাবর বিদ্যালয়ে প্রথম স্থান অধিকার করতেন।
কিন্তু সেকালের সাধারণ পরিবারের রীতিনীতি মেনে বাল্যকালেই বিয়ের পিঁড়িতে গিয়ে
বসতে হল তাঁকে। অতএব বিধিবদ্ধ পড়াশুনোয় ইতি। ঘটল কিন্তু মন ততদিনেই প্রস্তুত হয়ে
গেছিল তাঁর। সাহিত্যে তাঁর গৌণভাবে দীক্ষা ঘটে গেছিল হেমচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র এবং রবীন্দ্রনাথের রচনার সাহায্যে। অসুস্থ বাবাকে পড়ে পড়ে
শোনাতেন বালিকা শৈল কখনো হেমচন্দ্রের কবিতা, কখনোও বা
বঙ্কিমচন্দ্রের কৃষ্ণ চরিত্র। তাই বঙ্কিম আর রবীন্দ্রনাথকে ভালো লাগা দিয়েই বালিকা
শৈলের মনের গান তৈরি হয়ে গেছিল।
১৩১৪ বঙ্গাব্দে শৈলবালা নন্দীর বিয়ে হল বর্ধমানের অনতিদূরে মেমারি গ্রামে এক বর্ধিষ্ণু পরিবারে মাত্র তেরো বছর বয়সে । স্বামী নরেন্দ্রমোহন ঘোষ। অতএব শৈলবালা নন্দী হলেন শৈলবালা ঘোষ। স্বামী মানুষটি পরিবার থেকে একটু বুঝি আলাদা। পরিবারের সবাই এগ্রিকালচারকেই একমাত্র ‘কালচার’ বলে মনে করেন, সম্পত্তি আর ধনদৌলতের কাছেই তাঁদের মন বাঁধা। স্বামী এর বাইরে সাহিত্য প্রিয় না হলেও একেবারে সাহিত্য বিরোধী নন। মেয়েদের সাহিত্যচর্চা সেকেলে এক বহুনিন্দিত ব্যাপার ছিল। তবুও নরেন্দ্রমোহন স্ত্রীর সাহিত্য সাধনাকে পোষকতাই করেছিলেন। নইলে কুঁড়িতেই শৈলবালার স্বপ্নের ইতি ঘটত।
কিন্তু এ থেকে যদি ভেবে নেওয়া হয় যে শৈলবালার দাম্পত্যজীবন সুখের ছিল, তবে বিষম বিপত্তি হয়ে যায়। কুঞ্জবিহারীর ছেলেরা― নরেন্দ্রমোহনের শ্যালকেরা ডাক্তারি পড়েছেন দেখে নরেন্দ্রমোহনও চিকিৎসক হবার বাসনায় হোমিওপ্যাথি পড়তে শুরু করলেন কলকাতায় এসে। জমিদার বংশের সন্তান হলেও পাকচক্রে সম্পত্তির আয় থেকে বঞ্চিত। অতএব শৈলবালার সাহিত্য চর্চা-জনিত আয় তাঁর বাসনা পূরণের উপকরণ হয়ে দাঁড়াল। বছর দশেক ভাল রইলেন নরেন্দ্রমোহন, আর তারপরেই স্বয়ং চিকিৎসক নিজেই মানসিক চিকিৎসার রোগী হয়ে গেলেন। একেবারে বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেলেন ১৩২৭ বঙ্গাব্দ নাগাদ। তখন শৈলবালার সাহিত্য চর্চা তাঁর দুচোখের বিষ। অবিরত চিৎকার-চেঁচামেচিতে শৈলবালার জীবন দুর্বিষহ। তাঁকে কখনও যান খুন করতে, কখনও বলেন― ‘আমার লেখা, সব আমার লেখা। তোমার নয়। তোমাকে আমি খুন করব― মেরে ফেলব।’ বাস্তবিকই একদিন প্রায় খুন করেই বসলেন। একবার এতো প্রচণ্ড জোরে মাথায় আঘাত করলেন যে, তারপর থেকেই চির জীবনের মত শৈলবালার দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে এল।
বাপের বাড়িতে খবর পৌঁছল। পিতা তখন গত। জ্যেষ্ঠভ্রাতা মেজর অশ্বিনীকুমার খবর পেয়ে তাঁকে নিয়ে এলেন মেমারি থেকে বর্ধমানে। এরপর ১৩৩৩ খ্রিস্টাব্দে শাশুড়ি এবং ১৩৩৬ খ্রিস্টাব্দে স্বামীর মৃত্যু ঘটল। মেমারিতে গেছেন বটে এরপর, কিন্তু সম্পর্কটাই ছিল মাত্র, মন ছিল না। তারপর একসময়ে সব পাট চুকিয়ে এলেন স্বামী অসীমানন্দের আশ্রমে। এবার বিবাহিত জীবনের শেষ বন্ধনটুকুরও অবসান ঘটল।
তবুও একথা শৈলবালা কোনদিনই ভুলতে পারেন নি যে একদিন তাঁর স্বামীই তাঁর সাহিত্যচর্চাকে হাত ধরে এগিয়ে দিয়েছিলেন। কুন্তলীন পুরস্কারের দেখাদেখি অনেক কেশ তৈল প্রস্তুত কারক সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতায় এগিয়ে এসেছিলেন। শর্মা ব্যানার্জী এণ্ড কোং প্রকাশ করেছিলেন নিরুপমা বর্ষস্মৃতির মতই নানা উপন্যাসাদিও। সে সময়ে বাংলার মফস্বলে মষিহর রহমানের বেগমবাহার তেলের খুব প্রচলন। তাঁরাও আহ্বান করে চলেছিলেন গল্প প্রতিযোগিতার জন্য গল্প। এমনি এক প্রতিযোগিতায় সাড়া দিয়ে গল্প পাঠিয়েছিলেন শৈলবালা। ফল প্রকাশিত হতে দেখা গেল তাঁর ‘বীণার সমাধি’ দ্বিতীয় পুরস্কার অর্জন করেছে। বলা বাহুল্য এই গল্প লেখার প্রেরণা দিয়েছিলেন নরেন্দ্রমোহন নিজে।
এর মধ্যে শৈলবালা ঘোষ হাত দিয়েছেন উপন্যাস রচনাতেও। শৈলবালা ঘোষ নয়, ঘোষ-জায়া। আত্মপরিচয়ের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত রাখার জন্যই নামের আগে ‘শ্রী’ এবং ব্যাকরণসম্মত ‘ঘোষজায়া’ পদবি ব্যবহার করতেন তিনি । শৈলবালার হাত দিয়ে তাঁর প্রথম রচিত গল্পের পর রচিত হল তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘শেখ আন্দু।’ এর পাণ্ডুলিপিও নরেন্দ্রমোহন অন্যের অগোচরে গিয়ে জমা দিয়ে আসলেন সেকালের শ্রেষ্ঠ মাসিক ‘প্রবাসী’র দপ্তরে। এবং বিস্ময়ের কথা সে সসম্মানে ধারাবাহিকভাবে ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় (১৩২২) পত্রস্থ হয়ে লেখিকা অর্থ এবং সম্মান ―দুই-ই এনে দিল। শ্বশুড়বাড়ির লোকেরা জানলেনই না (মাত্র কয়েকজন বাদে) যে এ তাদেরই পরিবারের বধূর রচনা। সমকালীন বাংলা সাহিত্যজগতে নিজস্ব ঘরানার স্পর্ধিত পদচারণা শুরু হল শ্রী শৈলবালা ঘোষজায়ার।
তারপরে শৈলবালার কলম বিশ্রাম নেয়নি, অজস্র রচনা প্রসব করে গেছে। এসেছে খ্যাতি এবং কিছু অর্থও। কিন্তু বিষময় জীবনে তাকে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে পারেননি শৈলবালা। এ সব রচনা যেন তাঁর মন থেকে, অত্যাচার থেকে পালিয়ে বাঁচার প্রাণ ভোমরা। কিন্তু একটা বিষয় তাঁর জীবনের প্রথম দুটি রচনাতেই অতিস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল―তা হল তাঁর রচনার পটভূমি এবং চরিত্র। রচনা শৈলীর গুণে না হোক এক অসাম্প্রদায়িক পরিবেশ রচনায় বাঙালি মহিলাকুলের অগ্রগণ্য লেখিকা হিসাবে তিনি স্মরণযোগ্য হয়ে থাকবেন। ‘বীণার সমাধি’ গল্পের বীণাসাধক নায়ক ছিলেন অবাঙালি এবং ‘শেখ আন্দু’র নায়ক তো মুসলমানই। অথচ মুসলমান সমাজে যে তিনি খুব একটা মেলামেশা করেছিলেন তা নয়। শুধু স্বপ্নে এঁদের দেখেছিলেন মঙ্গলকাব্যের কবিদের মত। তাই শৈলবালার চরিত্রচিত্রণ আধুনিক বাংলা উপন্যাসের মঙ্গলকাব্য স্বরূপ। বস্তুতপক্ষে শৈলবালার বই গল্প উপন্যাসেরই চরিত্রগুলি মুসলমান সমাজ থেকে আগত। তাঁর ‘মিষ্টি সরবৎ’ বইয়ে আছে মুসলমান পরিবারের চিত্র, ‘অভিশপ্ত সাধনা’র নায়িকার নাম ‘রাবোয়া’। আর ‘শেখ আন্দু’ উপন্যাস লেখার সময় এতই তিনি চরিত্রমগ্ন হয়ে থাকতেন যে একদিন ছোট-জাকেই ‘শেখ আন্দু’ বলে সম্বোধন করে বলে উঠেছিলেন― ‘শেখ আন্দু, রোদ আসছে মাথার কাছে জানালাটা বন্ধ করে দিয়ে যাও।’ এই আত্মমগ্নতা ও বিষয়মগ্নতা ছিল বলেই শৈলবালা বেঁচে গেছিলেন― নইলে তাঁকে হয়ত আত্মহননের পথ বেছে নিতে হত। কথাসাহিত্যিককে জীবন রসিক হতেই হয়।
শৈলবালা বহু গ্রন্থের রচয়িতা― আগেই বলেছি। কথাসাহিত্যের পাশে পাশে বিচিত্রচারী রচনাতেও তিনি দক্ষ ছিলেন। ‘বঙ্গশ্রী’ পত্রিকায় প্রকাশিত রহস্য উপন্যাস ‘চৌকো চোয়াল’ অথবা ছোটদের রহস্যোপাখ্যান ‘জন্ম পতাকা’ তার প্রমাণ। ছোট গল্প রচনায় তাঁর দক্ষতা ছিল তর্কাতীত। সেই সুবাদেই নানা পত্র-পত্রিকায় তাঁর যাতায়াত। কখনও লিখেছেন বসুমতী-প্রবাসী-ভারতবর্ষে। কখনও বা সচিত্র, শিশির বা কল্লোলে। ‘কল্লোলে’ তাঁর এক গল্পই প্রকাশিত হয়েছিল― পৌষ ১৩৩১ সংখ্যায় ‘পাহাড়ের পথে।’ তাঁর অবাক্, আয়েসা, লোকসানের সন্ধ্যায় (১৩২৮-২৯) প্রভৃতি গল্পেও মুসলমান জীবন আলোচিত। তবুও তাঁর উপন্যাস যতখানি দুঃসাহসিকতায় পরিপূর্ণ, দৃষ্টিভঙ্গির ততখানি দুঃসাহস ছোটগল্পে সাড়া জাগাতে পারেনি। ভূদেব চৌধুরী ঠিকই লিখেছেন― ‘কিন্তু তথাকথিত অন্ত্যজ, দরিদ্র, অশিক্ষিত মানুষের দেহ-মন-চরিত্রে অনপনেয় দুর্বলতার প্রতি লেখিকার মানবিক সহৃদয়তার পরিচয় গোপনও থাকেনি কোথাও’। শিল্পসম্মত গল্প রচনার চেয়ে অভিনবতা ও দুঃসাহস সৃষ্টিতেই তাঁর আকর্ষণ ছিল বেশি। মনীষা, আয়েসা, আদেশ পালন, রুদ্রকান্ত, শঠে শাঠ্যং প্রভৃতি গল্পে শৈলবালা অবশ্যই স্মরণীয় হয়ে আছেন। তাঁর গল্পগ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য আড়াইচাল (১৯১৯), মনীষা (১৯২০), অকালকুষ্মাণ্ডের কীর্তি ও স্মৃতিচিহ্ন (১৯২২), রুদ্রকান্ত (১৯৩৪) প্রভৃতি।’
উপন্যাসেও তিনি স্মরণীয় হবার দাবি রাখেন, ‘শেখ আন্দু’ উপন্যাসের মুসলমান ড্রাইভারটিকে ভুলে থাকা বাস্তবিকই কষ্টকর। মিষ্টি সরবৎ (১৯২০), অবাক (১৯২৫), নমিতা (১৯১৮), জন্মে অপরাধী (১৯২০) জন্মে অভিশপ্তা (১৯২১), মঙ্গলমঠ (১৯২১), ইমানাদার (১৯২২), মহিমাদেবী (১৯২৭) প্রভৃতি বই ছাড়া ‘বিনীতাদি’ নামে উপন্যাস লেখিকার পছন্দ ছিল। তবে তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘শেখ আন্দু’র পাশে আর যে উপন্যাসটিকে তিনি নিজে যথেষ্ট মূল্য দিতেন তা তাঁর শেষ জীবনের রচনা ‘বিপত্তি’।
বিয়ের পর বর্ধমানে একবার এলে এক ভাইপো তাঁর বন্ধু অন্নদাপ্রসাদ চক্রবর্তীকে নিয়ে আসেন, ক্লাসের ফার্স্ট বয় বলে পরিচয় করিয়ে দেন। অন্নদাপ্রসাদ সেদিন শৈলবালাকে প্রণাম করেছিলেন, মা বলে করেছিলেন সম্বোধন। পরবর্তীকালে আসানসোল-আদ্রা লাইনের মুরাডি স্টেশনের অনতিদূরে রামচন্দ্রপুরের মহাশ্মশানে অন্নদাপ্রসাদ স্থাপন করেছেন আশ্রম। বিপ্লবী অন্নদাপ্রসাদ তখন স্বামী অসীমানন্দ। এখানে তাঁর উপর হয়েছে ইংরেজি পুলিশের বর্বর অত্যাচার। নেতাজী সুভাষচন্দ্র এসেছেন এখানে। তারপর নিরিবিলিতে প্রতিষ্ঠিত হয় শ্রীশ্রী বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী নামাঙ্কিত এই আশ্রম। এখানেই শৈলবালা সন্ধান পেয়েছেন তাঁর জীবনের গভীর প্রশান্তি। বাকী জীবনগুলি এখানেই কেটে গেছে। এই আশ্রমের তিনি ছিলেন মা ও ঠাকুরমা। এখানেই অনুষ্ঠিত হয়েছে বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের অধিবেশন। এই আশ্রমেই ৮০ বছর বয়সে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন।
জীবনে শুধু স্বস্তি-শান্তি নয়, সম্মানও এসে উপস্থিত হয়েছিল শৈলবালার দ্বারদেশে। কলকাতার স্নাতক মহিলা সংস্থা ও সাহিত্যকার যৌথ উদ্যোগে লীলা মজুমদার ও মহাশ্বেতা দেবীর উদ্যমে অনুষ্ঠিত মহিলা সাহিত্যিক সম্বর্ধনার আমলে আরও পাঁচজন প্রবীণা মহিলার সঙ্গে সম্বর্ধনা জানানো হয়েছিল শৈলবালাকেও। এদিনের ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের সময়ে মেয়েদের এত সুযোগ ছিল না, তার জন্য আমরা কষ্ট পেয়েছি। এখনকার মেয়েরা তোমরা এগিয়ে এসো সব দিক থেকে’। আক্ষেপকে উৎসাহে রূপান্তরিত করা তাঁর পক্ষে স্বতই সহজ ছিল।
এছাড়া কবিকঙ্কণ চণ্ডীর উপর এক তথ্যমূলক প্রবন্ধ রচনাকার তিনি ‘সরস্বতী’ উপাধি পান এবং নদীয়ার ‘মানদমণ্ডলী’র কাছ থেকে তিনি পান ‘সাহিত্যভারতী’ ও ‘রত্নপ্রভা’ উপাধি দুটি।
১৩১৪ বঙ্গাব্দে শৈলবালা নন্দীর বিয়ে হল বর্ধমানের অনতিদূরে মেমারি গ্রামে এক বর্ধিষ্ণু পরিবারে মাত্র তেরো বছর বয়সে । স্বামী নরেন্দ্রমোহন ঘোষ। অতএব শৈলবালা নন্দী হলেন শৈলবালা ঘোষ। স্বামী মানুষটি পরিবার থেকে একটু বুঝি আলাদা। পরিবারের সবাই এগ্রিকালচারকেই একমাত্র ‘কালচার’ বলে মনে করেন, সম্পত্তি আর ধনদৌলতের কাছেই তাঁদের মন বাঁধা। স্বামী এর বাইরে সাহিত্য প্রিয় না হলেও একেবারে সাহিত্য বিরোধী নন। মেয়েদের সাহিত্যচর্চা সেকেলে এক বহুনিন্দিত ব্যাপার ছিল। তবুও নরেন্দ্রমোহন স্ত্রীর সাহিত্য সাধনাকে পোষকতাই করেছিলেন। নইলে কুঁড়িতেই শৈলবালার স্বপ্নের ইতি ঘটত।
কিন্তু এ থেকে যদি ভেবে নেওয়া হয় যে শৈলবালার দাম্পত্যজীবন সুখের ছিল, তবে বিষম বিপত্তি হয়ে যায়। কুঞ্জবিহারীর ছেলেরা― নরেন্দ্রমোহনের শ্যালকেরা ডাক্তারি পড়েছেন দেখে নরেন্দ্রমোহনও চিকিৎসক হবার বাসনায় হোমিওপ্যাথি পড়তে শুরু করলেন কলকাতায় এসে। জমিদার বংশের সন্তান হলেও পাকচক্রে সম্পত্তির আয় থেকে বঞ্চিত। অতএব শৈলবালার সাহিত্য চর্চা-জনিত আয় তাঁর বাসনা পূরণের উপকরণ হয়ে দাঁড়াল। বছর দশেক ভাল রইলেন নরেন্দ্রমোহন, আর তারপরেই স্বয়ং চিকিৎসক নিজেই মানসিক চিকিৎসার রোগী হয়ে গেলেন। একেবারে বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেলেন ১৩২৭ বঙ্গাব্দ নাগাদ। তখন শৈলবালার সাহিত্য চর্চা তাঁর দুচোখের বিষ। অবিরত চিৎকার-চেঁচামেচিতে শৈলবালার জীবন দুর্বিষহ। তাঁকে কখনও যান খুন করতে, কখনও বলেন― ‘আমার লেখা, সব আমার লেখা। তোমার নয়। তোমাকে আমি খুন করব― মেরে ফেলব।’ বাস্তবিকই একদিন প্রায় খুন করেই বসলেন। একবার এতো প্রচণ্ড জোরে মাথায় আঘাত করলেন যে, তারপর থেকেই চির জীবনের মত শৈলবালার দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে এল।
বাপের বাড়িতে খবর পৌঁছল। পিতা তখন গত। জ্যেষ্ঠভ্রাতা মেজর অশ্বিনীকুমার খবর পেয়ে তাঁকে নিয়ে এলেন মেমারি থেকে বর্ধমানে। এরপর ১৩৩৩ খ্রিস্টাব্দে শাশুড়ি এবং ১৩৩৬ খ্রিস্টাব্দে স্বামীর মৃত্যু ঘটল। মেমারিতে গেছেন বটে এরপর, কিন্তু সম্পর্কটাই ছিল মাত্র, মন ছিল না। তারপর একসময়ে সব পাট চুকিয়ে এলেন স্বামী অসীমানন্দের আশ্রমে। এবার বিবাহিত জীবনের শেষ বন্ধনটুকুরও অবসান ঘটল।
তবুও একথা শৈলবালা কোনদিনই ভুলতে পারেন নি যে একদিন তাঁর স্বামীই তাঁর সাহিত্যচর্চাকে হাত ধরে এগিয়ে দিয়েছিলেন। কুন্তলীন পুরস্কারের দেখাদেখি অনেক কেশ তৈল প্রস্তুত কারক সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতায় এগিয়ে এসেছিলেন। শর্মা ব্যানার্জী এণ্ড কোং প্রকাশ করেছিলেন নিরুপমা বর্ষস্মৃতির মতই নানা উপন্যাসাদিও। সে সময়ে বাংলার মফস্বলে মষিহর রহমানের বেগমবাহার তেলের খুব প্রচলন। তাঁরাও আহ্বান করে চলেছিলেন গল্প প্রতিযোগিতার জন্য গল্প। এমনি এক প্রতিযোগিতায় সাড়া দিয়ে গল্প পাঠিয়েছিলেন শৈলবালা। ফল প্রকাশিত হতে দেখা গেল তাঁর ‘বীণার সমাধি’ দ্বিতীয় পুরস্কার অর্জন করেছে। বলা বাহুল্য এই গল্প লেখার প্রেরণা দিয়েছিলেন নরেন্দ্রমোহন নিজে।
এর মধ্যে শৈলবালা ঘোষ হাত দিয়েছেন উপন্যাস রচনাতেও। শৈলবালা ঘোষ নয়, ঘোষ-জায়া। আত্মপরিচয়ের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত রাখার জন্যই নামের আগে ‘শ্রী’ এবং ব্যাকরণসম্মত ‘ঘোষজায়া’ পদবি ব্যবহার করতেন তিনি । শৈলবালার হাত দিয়ে তাঁর প্রথম রচিত গল্পের পর রচিত হল তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘শেখ আন্দু।’ এর পাণ্ডুলিপিও নরেন্দ্রমোহন অন্যের অগোচরে গিয়ে জমা দিয়ে আসলেন সেকালের শ্রেষ্ঠ মাসিক ‘প্রবাসী’র দপ্তরে। এবং বিস্ময়ের কথা সে সসম্মানে ধারাবাহিকভাবে ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় (১৩২২) পত্রস্থ হয়ে লেখিকা অর্থ এবং সম্মান ―দুই-ই এনে দিল। শ্বশুড়বাড়ির লোকেরা জানলেনই না (মাত্র কয়েকজন বাদে) যে এ তাদেরই পরিবারের বধূর রচনা। সমকালীন বাংলা সাহিত্যজগতে নিজস্ব ঘরানার স্পর্ধিত পদচারণা শুরু হল শ্রী শৈলবালা ঘোষজায়ার।
তারপরে শৈলবালার কলম বিশ্রাম নেয়নি, অজস্র রচনা প্রসব করে গেছে। এসেছে খ্যাতি এবং কিছু অর্থও। কিন্তু বিষময় জীবনে তাকে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে পারেননি শৈলবালা। এ সব রচনা যেন তাঁর মন থেকে, অত্যাচার থেকে পালিয়ে বাঁচার প্রাণ ভোমরা। কিন্তু একটা বিষয় তাঁর জীবনের প্রথম দুটি রচনাতেই অতিস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল―তা হল তাঁর রচনার পটভূমি এবং চরিত্র। রচনা শৈলীর গুণে না হোক এক অসাম্প্রদায়িক পরিবেশ রচনায় বাঙালি মহিলাকুলের অগ্রগণ্য লেখিকা হিসাবে তিনি স্মরণযোগ্য হয়ে থাকবেন। ‘বীণার সমাধি’ গল্পের বীণাসাধক নায়ক ছিলেন অবাঙালি এবং ‘শেখ আন্দু’র নায়ক তো মুসলমানই। অথচ মুসলমান সমাজে যে তিনি খুব একটা মেলামেশা করেছিলেন তা নয়। শুধু স্বপ্নে এঁদের দেখেছিলেন মঙ্গলকাব্যের কবিদের মত। তাই শৈলবালার চরিত্রচিত্রণ আধুনিক বাংলা উপন্যাসের মঙ্গলকাব্য স্বরূপ। বস্তুতপক্ষে শৈলবালার বই গল্প উপন্যাসেরই চরিত্রগুলি মুসলমান সমাজ থেকে আগত। তাঁর ‘মিষ্টি সরবৎ’ বইয়ে আছে মুসলমান পরিবারের চিত্র, ‘অভিশপ্ত সাধনা’র নায়িকার নাম ‘রাবোয়া’। আর ‘শেখ আন্দু’ উপন্যাস লেখার সময় এতই তিনি চরিত্রমগ্ন হয়ে থাকতেন যে একদিন ছোট-জাকেই ‘শেখ আন্দু’ বলে সম্বোধন করে বলে উঠেছিলেন― ‘শেখ আন্দু, রোদ আসছে মাথার কাছে জানালাটা বন্ধ করে দিয়ে যাও।’ এই আত্মমগ্নতা ও বিষয়মগ্নতা ছিল বলেই শৈলবালা বেঁচে গেছিলেন― নইলে তাঁকে হয়ত আত্মহননের পথ বেছে নিতে হত। কথাসাহিত্যিককে জীবন রসিক হতেই হয়।
শৈলবালা বহু গ্রন্থের রচয়িতা― আগেই বলেছি। কথাসাহিত্যের পাশে পাশে বিচিত্রচারী রচনাতেও তিনি দক্ষ ছিলেন। ‘বঙ্গশ্রী’ পত্রিকায় প্রকাশিত রহস্য উপন্যাস ‘চৌকো চোয়াল’ অথবা ছোটদের রহস্যোপাখ্যান ‘জন্ম পতাকা’ তার প্রমাণ। ছোট গল্প রচনায় তাঁর দক্ষতা ছিল তর্কাতীত। সেই সুবাদেই নানা পত্র-পত্রিকায় তাঁর যাতায়াত। কখনও লিখেছেন বসুমতী-প্রবাসী-ভারতবর্ষে। কখনও বা সচিত্র, শিশির বা কল্লোলে। ‘কল্লোলে’ তাঁর এক গল্পই প্রকাশিত হয়েছিল― পৌষ ১৩৩১ সংখ্যায় ‘পাহাড়ের পথে।’ তাঁর অবাক্, আয়েসা, লোকসানের সন্ধ্যায় (১৩২৮-২৯) প্রভৃতি গল্পেও মুসলমান জীবন আলোচিত। তবুও তাঁর উপন্যাস যতখানি দুঃসাহসিকতায় পরিপূর্ণ, দৃষ্টিভঙ্গির ততখানি দুঃসাহস ছোটগল্পে সাড়া জাগাতে পারেনি। ভূদেব চৌধুরী ঠিকই লিখেছেন― ‘কিন্তু তথাকথিত অন্ত্যজ, দরিদ্র, অশিক্ষিত মানুষের দেহ-মন-চরিত্রে অনপনেয় দুর্বলতার প্রতি লেখিকার মানবিক সহৃদয়তার পরিচয় গোপনও থাকেনি কোথাও’। শিল্পসম্মত গল্প রচনার চেয়ে অভিনবতা ও দুঃসাহস সৃষ্টিতেই তাঁর আকর্ষণ ছিল বেশি। মনীষা, আয়েসা, আদেশ পালন, রুদ্রকান্ত, শঠে শাঠ্যং প্রভৃতি গল্পে শৈলবালা অবশ্যই স্মরণীয় হয়ে আছেন। তাঁর গল্পগ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য আড়াইচাল (১৯১৯), মনীষা (১৯২০), অকালকুষ্মাণ্ডের কীর্তি ও স্মৃতিচিহ্ন (১৯২২), রুদ্রকান্ত (১৯৩৪) প্রভৃতি।’
উপন্যাসেও তিনি স্মরণীয় হবার দাবি রাখেন, ‘শেখ আন্দু’ উপন্যাসের মুসলমান ড্রাইভারটিকে ভুলে থাকা বাস্তবিকই কষ্টকর। মিষ্টি সরবৎ (১৯২০), অবাক (১৯২৫), নমিতা (১৯১৮), জন্মে অপরাধী (১৯২০) জন্মে অভিশপ্তা (১৯২১), মঙ্গলমঠ (১৯২১), ইমানাদার (১৯২২), মহিমাদেবী (১৯২৭) প্রভৃতি বই ছাড়া ‘বিনীতাদি’ নামে উপন্যাস লেখিকার পছন্দ ছিল। তবে তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘শেখ আন্দু’র পাশে আর যে উপন্যাসটিকে তিনি নিজে যথেষ্ট মূল্য দিতেন তা তাঁর শেষ জীবনের রচনা ‘বিপত্তি’।
বিয়ের পর বর্ধমানে একবার এলে এক ভাইপো তাঁর বন্ধু অন্নদাপ্রসাদ চক্রবর্তীকে নিয়ে আসেন, ক্লাসের ফার্স্ট বয় বলে পরিচয় করিয়ে দেন। অন্নদাপ্রসাদ সেদিন শৈলবালাকে প্রণাম করেছিলেন, মা বলে করেছিলেন সম্বোধন। পরবর্তীকালে আসানসোল-আদ্রা লাইনের মুরাডি স্টেশনের অনতিদূরে রামচন্দ্রপুরের মহাশ্মশানে অন্নদাপ্রসাদ স্থাপন করেছেন আশ্রম। বিপ্লবী অন্নদাপ্রসাদ তখন স্বামী অসীমানন্দ। এখানে তাঁর উপর হয়েছে ইংরেজি পুলিশের বর্বর অত্যাচার। নেতাজী সুভাষচন্দ্র এসেছেন এখানে। তারপর নিরিবিলিতে প্রতিষ্ঠিত হয় শ্রীশ্রী বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী নামাঙ্কিত এই আশ্রম। এখানেই শৈলবালা সন্ধান পেয়েছেন তাঁর জীবনের গভীর প্রশান্তি। বাকী জীবনগুলি এখানেই কেটে গেছে। এই আশ্রমের তিনি ছিলেন মা ও ঠাকুরমা। এখানেই অনুষ্ঠিত হয়েছে বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের অধিবেশন। এই আশ্রমেই ৮০ বছর বয়সে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন।
জীবনে শুধু স্বস্তি-শান্তি নয়, সম্মানও এসে উপস্থিত হয়েছিল শৈলবালার দ্বারদেশে। কলকাতার স্নাতক মহিলা সংস্থা ও সাহিত্যকার যৌথ উদ্যোগে লীলা মজুমদার ও মহাশ্বেতা দেবীর উদ্যমে অনুষ্ঠিত মহিলা সাহিত্যিক সম্বর্ধনার আমলে আরও পাঁচজন প্রবীণা মহিলার সঙ্গে সম্বর্ধনা জানানো হয়েছিল শৈলবালাকেও। এদিনের ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের সময়ে মেয়েদের এত সুযোগ ছিল না, তার জন্য আমরা কষ্ট পেয়েছি। এখনকার মেয়েরা তোমরা এগিয়ে এসো সব দিক থেকে’। আক্ষেপকে উৎসাহে রূপান্তরিত করা তাঁর পক্ষে স্বতই সহজ ছিল।
এছাড়া কবিকঙ্কণ চণ্ডীর উপর এক তথ্যমূলক প্রবন্ধ রচনাকার তিনি ‘সরস্বতী’ উপাধি পান এবং নদীয়ার ‘মানদমণ্ডলী’র কাছ থেকে তিনি পান ‘সাহিত্যভারতী’ ও ‘রত্নপ্রভা’ উপাধি দুটি।
আজ শৈলবালা নেই, কিন্তু তাঁর স্ত্রীজাতির প্রতি আহ্বান আজও নশ্বর হয়ে আছে - "সাহিত্য চর্চাটা সেযুগে ছিল মেয়েদের পক্ষে সমাজদ্রোহিতা, অপরাধ.......আজ সেদিন চলে গেছে।.....সমগ্র দেশ নতুন চেতনায় জেগে উঠুক। জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিরোধ ব্যক্তিত্বের আলোয় সমগ্র দেশ সমুজ্জ্বল হয়ে উঠুক।"
0 Comments