মানস রায়, মেমারি: বাংলার সবথেকে প্রাচীন মন্দিরগুলোর মধ্যে দেউল অন্যতম। খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শতাব্দীর মধ্যবর্তী কোনও এক সময়ে দেউল শিল্পরীতির বিকাশ ঘটে। বর্ধমান জেলাতেও কিছু দেউল এখনো মাথা তুলে অতীতের স্মৃতিচারণ করছে। এমনই একটি দেউল আছে বর্ধমান শহর থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে, আঝাপুরের সাতদেউল ।জামাল্পুর থানার অন্তর্গত আঝাপুর মৌজায় অবস্থিত সাত দেউলিয়া বা দেউলিয়া একটি প্রসিদ্ধ স্থান।
উড়িষ্যার রেখা দেউল স্থাপত্য শৈলীতে ইঁট দ্বারা নির্মিত এই সাত দেউল প্রাচীন বাংলার জৈন কৃষ্টির এক অমূল্য সাক্ষ্য । উড়িষ্যার রেখা দেউল রীতিতে বিন্যস্ত এই মন্দিরটি অলংকৃত ইষ্টক নির্মিত ও পঞ্চ রথাকৃতির মন্দিরের প্রবেশ দ্বারে ক্রমবর্ধমান খিলানের ব্যবহার, অপূর্ব কারুকার্য এবং বর্হিরগাত্রে চৈত গবাক্ষের মনোরম বিন্যাস উল্লেখযোগ্য।
প্রসঙ্গত বলে রাখি-
পশ্চিমবাংলার দেবালয় গুলো প্রধানত চার ধরনের -১।চালা ২। রত্ন ৩। শিখর বা রেখ এবং ৪। দালান।
রেখ শৈলীতে নির্মিত মন্দির গুলো আবার তিন রকমের। যেমন-
১। উড়িষ্যা প্রভাবিত রেখ দেউল
2। পীড়া দেউল এবং
৩। বঙ্গীয় রেখ শৈলী।
কথিত আছে পালযুগের রাজা শালিবাহন এই দেউল নির্মাণ করেছিলেন ।মন্দিরটির ভিত পঞ্চরত্ন আলেখ্যে তৈরি। এর বিশেষত্ব হচ্ছে চতুর্দিকে বিশাল বাঁকানো সুউচ্চ টাওয়ার ও প্রবেশদ্বারে রয়েছে ধনুকাকৃতি গেট। প্রবেশদ্বারের ওপরে, বাইরের দেওয়ালে রয়েছে সুন্দর কারুকার্যখচিত চৈত্য-জানালা। মন্দিরের গঠন শৈলী থেকে নির্মানের সময়কাল আনুমানিক খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দী বলে মনে করা হয়। দেউলের ভিতরে কোনো বিগ্রহ বা মূর্তি নেই।
বর্ধমান থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত আঝাপুর । এখানকার দেউলিয়া বা সাত দেউলিয়া নামক গ্রামে সাত দেউলের অবস্থান। সাত দেউলিয়া গ্রামে খ্রিস্টীয় নবম শতকে যে শিখর দেউলটি নির্মিত হয়েছিল তার স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের জন্য দূর দুরান্ত থেকে পন্ডিত ও গবেষকরা এখানে উপস্থিত হন। বাঁকুড়া জেলার বহুলারা এবং বর্ধমান জেলার সাতদেউলিয়ার ইস্টক নির্মিত দুটি প্রাচীন শিখর দেউল ব্যাতীত সমগ্র বঙ্গদেশে অপর কোন মন্দিরের নিদর্শন জানা যায়নি। মন্দিরটি প্রায় ৮০ ফুট উঁচু ও দেওয়াল প্রায় ৯ ফুট চওড়া।
নবম শতকে নির্মিত এই জৈন দেবালয়টি সম্ভবত কোন তীর্থঙ্করের উদ্দেশ্যে অর্পিত হয়েছিল। দেউলের উপরিভাগে একখণ্ড প্রস্তরের উপর ১৪১ টি তীর্থঙ্করের মূর্তি খোদিত আছে। যার ঊর্ধবভাগে উপবিষ্ট আছেন বৃষভবাহন সহ স্বয়ং ঋষভ নাথ। বর্তমানে খোদিত প্রস্তর খন্ডটি বেহালার সরকারি মিউজিয়ামে রক্ষিত আছে।
শোনা যায় অতীতে এখানে ৭ টি দেউল ছিল, সেকারণে স্থাননাম হয়েছিল সাতদেউলিয়া। বর্তমানে একটিমাত্র দেউল অবশিষ্ট আছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে, এই স্থানের বাসিন্দারা সকলেই মুসলমান, কিন্তু মন্দিরটি রক্ষণাবেক্ষণর ব্যাপারে তাদের আন্তরিকতার সীমা নেই।
বর্তমানে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ বিভাগ থেকে দেউলটি ভালভাবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। বিভিন্ন ফুলের গাছপালা লাগিয়ে , বাহারি গাছ ছেঁটে এবং ইটের সারি দিয়ে সুন্দর ফুলের গাছ লাগানো হয়েছে। গেট থেকে দেউল পর্যন্ত সুরকি বিছানো সুন্দর পথ ও তৈরি করা হয়েছে। একটা দিন বেড়িয়ে আসার পক্ষে এলাকাটি খুবই উপযোগী।
বর্ধমান হাওড়া কর্ডলাইনে মসাগ্রাম স্টেশনে অথবা বর্ধমান হাওড়া মেন লাইনে মেমারি স্টেশনে নেমেও এখানে পৌঁছানো যায় টোটো অথবা ট্রেকারে।
#UnknownFACTS
0 Comments