নিবেদিতা: জননী,সেবিকা,বন্ধু

নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু বিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষকে একবার বলেছিলেন 'ভারতবর্ষকে আমি ভালোবেসেছি বিবেকানন্দ পড়ে।আর বিবেকানন্দকে আমি চিনেছি নিবেদিতার লেখায়'। হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন এই নিবেদিতাই হলেন সেই মহিয়ষী যাকে আমরা সিস্টার নিবেদিতা(Sister Nivedita) নামে জানি।।যাঁর প্রকৃত নাম মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেল।

উত্তর আয়ারল্যান্ডের একটি ছোট্ট শহরে 1867 সালে জন্ম নেন এই মহিয়ষী নারী। যিনি স্বামী বিবেকানন্দের আহ্বানে 1898 সালে কলকাতায় এসে পৌঁছান।
1899 খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাস।একদিন গঙ্গার উপরে নৌকার ছাদে বসে স্বামীজী কথা বলছেন নিবেদিতার সঙ্গে।কথাপ্রসঙ্গে স্বামীজী বললেন: 'প্রকৃত মনুষ্যত্বের স্বরূপ এখনো আমরা জানিনা।যখন প্রকৃত মনুষ্যত্বের উদয় হবে তখন আর দেখবার প্রয়োজন হবেনা।কোন পথে সবচেয়ে কম বাধা আসবে।তখন প্রত্যেকেরই স্বাধীনতা থাকবে মহৎ কাজ করার।আমার উদ্দেশ্য হল, সাধারণ মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ব আনা।' নিবেদিতা বললেন: 'স্বামীজী, এ কাজে আমি আপনাকে সাহায্য করব।' স্বামীজী বললেন: 'আমি তা জানি' স্বামীজিকে দেওয়া এই প্রতিশ্রুতি নিবেদিতা সর্বোতভাবে পালন করেছেন। তাঁর জীবন তিনি এই কাজেই উৎসর্গ করেছেন।
স্বামীজীর দেহরক্ষার পর নিবেদিতা অনুভব করলেন স্বামীজীর ভাবে সমগ্র ভারতবাসীর মধ্যে দেশাত্মবোধ জাগিয়ে তুলতে হবে। তাই তিনি সারা দেশ ঘুরে বক্তৃতা সফর শুরু করলেন। 1904 সালের জানুয়ারি মাসে পাটনায় ছাত্রদের সামনে তিনি একটি বক্তৃতা করলেন।তিনি বললেন 'বালকদের মুখে অপরিমেয় শান্তি দেখলে আমি দুঃখিত হব।আমি চাই তোমরা নিজেদের মধ্যে মল্ল যুদ্ধ করো, বক্সিং করো, তরবারি খেল। শান্তশিষ্ট গো-বেচারা লোক চাইনা। চাই শক্তিধর মানুষ।' আর বললেন 'কেবল বলিষ্ঠ হওয়ায় যথেষ্ট নয়, বীর হতে হবে। সেই হল বীর যে লড়াই করতে ভালোবাসে। লড়াই করো, লড়াই করো, কেবল লড়াই করো।কিন্তু তাতে নীচতা বা তিক্ততা যেন না থাকে। ......যখন সংগ্রামের ডাক আসবে যেন ঘুমিয়ে থেকোনা'
1906 সালের জুলাই মাসের মাঝামাঝি খবর এল, পূর্ববঙ্গে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে।সঙ্গে সঙ্গে বেলুড় মঠ থেকে কয়েকজন সন্ন্যাসী ও ব্রহ্মকারীকে সেই অঞ্চলে সেবার জন্য পাঠানো হল ।নিবেদিতা তখন প্রচন্ড অসুস্থ।কিছুদিন আগেই ব্রেন ফিভারে ভুগেছেন।তবুও সকলের নিষেধ অগ্রাহ্য করে দুর্ভিক্ষ পীড়িত অঞ্চলে গিয়ে হাজির হলেন এবং ত্রাণের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লেন।দীর্ঘদিন সেখানে থেকে গ্রামের মানুষের সেবা করলেন।গ্রাম্য রমণীরা তাকে আপনজন বলে গ্রহণ করে তাদের দুঃখ দুর্দশার কথা উজাড় করে ঢেলে দিত তাঁর কাছে।গ্রাম্য মানুষ গুলির দুঃখ দুর্দশার সাথে পরিচিত হবার সঙ্গে সঙ্গে তিনি তাদের মহত্বের পরিচয় পেয়েও মুগ্ধ হতেন।
নিবেদিতা মনে প্রানে বিশ্বাস করতেন ভারতবর্ষের জাগরণ শুধু রাজনৈতিক বা ধর্মীয় ক্ষেত্রেই হবেনা, বিজ্ঞান, শিক্ষা, সাহিত্য, ইতিহাস, শিল্প সবক্ষেত্রেই এই জাগরণ ঘটবে এবং তার জন্যই নিবেদিতা তাঁর সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন।


ভারতে এসেই পরিচয় হয়েছিল প্রখ্যাত বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুর সাথে। বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী হওয়া সত্বেও শুধুমাত্র পরাধীন দেশের মানুষ বলে তাঁর প্রতিভার লাঞ্ছনা দেখে নিবেদিতা ব্যথিত হয়েছিলেন।এই বিজ্ঞান পাগল মানুষটি হয়ে উঠেছিলেন একাধারে তাঁর বন্ধু ও সন্তান।1901 খ্রিস্টাব্দে রয়্যাল সোসাইটি জগদীশ চন্দ্রের গবেষণালব্ধ প্রবন্ধের প্রকাশ বন্ধ করে দেয়।তখন জগদীশ ঠিক করেন, তিনি তাঁর গবেষণা -বিষয়ক ফল গ্রন্থাকারে প্রকাশ করবেন। সেই সময় থেকে 1907 পর্যন্ত জগদীশ চন্দ্রের যে তিনখানি বিখ্যাত গ্রন্থ বের হয়, তার প্রতিটি নিবেদিতা শুধু সম্পাদনাই করেননি,তাদের ভাষাও অনেকাংশে নিবেদিতার।জগদীশ চন্দ্রকে নিবেদিতা জাতীয় সম্পদ হিসেবে মনে করতেন।রবীন্দ্রনাথএর ভাষায় 'তাঁর কাজে ও রচনায় উৎসহদাত্রীরূপে মূল্যবান সহায় হিসেবে তিনি পেয়েছিলেন ভগিনী নিবেদিতাকে।জগদীশ চন্দ্রের জীবনের ইতিহাসে এই মহানীয়া নারীর নাম সম্মানের সঙ্গে রক্ষার যোগ্য।'বসু বিজ্ঞান মন্দির প্রতিষ্ঠার সময় সরকারের কাছ থেকে প্রতি পদে পদে বাধা পেয়েও নিবেদিতার আন্তরিক সহযোগিতায় শেষ পর্যন্ত তা প্ৰতিষ্ঠা সম্ভব হয়।


জাতীয়তা বিষয়ে নিবেদিতার সর্বশ্রেষ্ঠ রচনা, 'ওয়েব অব ইন্ডিয়ান লাইফ'। বইটি প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশে-বিদেশে সাড়া ফেলেছিল। ভারতসংস্কৃতির গভীর শ্রদ্ধাপূর্ন ব্যাখ্যা রয়েছে ঐ গ্রন্থটিতে।পাশ্চাত্য পন্ডিতেরা এ পর্যন্ত ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে নিয়ে যত অপব্যাখ্যা করেছেন,এই গ্রন্থ লিখে নিবেদিতা তার সমুচিত জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
ভারতীয় অখন্ডতা রক্ষার জন্য নিবেদিতার সুমহান আহ্বান, 'আমি বিশ্বাস করি, ভারতবর্ষ এক অখন্ড অবিভাজ্য।এক আবাস,এক স্বার্থ, এক সম্প্রীতির উপরেই জাতীয় ঐক্য গঠিত।'
'অশিক্ষিত বিচ্ছিন্ন একটি মানুষের উপর অবিচার করা সহজ, কিন্তু সচেতন, সংহত দশ হাজার মানুষের উপর অবিচার করা কঠিন।'
'সঙ্কটে ভীত, নিরাপত্তার জন্য লালায়িত আধ্যাত্মিকতা হল কপট আধ্যাত্মিকতা। আধ্যাত্মিকতার ছদ্মবেশ পরে ঘৃণ্য স্বাচ্ছন্দ্যের সন্ধানী, জীবনের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে কাপুরুষের মতো পলায়িত দেশপ্রেম, সে হল কপট দেশপ্রেম।'
রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় নিবেদিতা প্রসঙ্গে বলেছেন, 'নিবেদিতা তাঁর প্রতিটি কার্য, প্রতিটি চিন্তা, জীবনের প্রত্যেক আবেগের অন্তর্বর্তী করে নিয়েছিলেন ভারতের আশা ও আদর্শকে। .......মনে হত যেন প্রাচীনকালের কোন ঋষির মুক্ত আত্মা এঁর(পাশ্চাত্য)দেহে পুনর্জন্ম গ্রহণ করেছে, যাতে পাশ্চাত্য জীবনিশক্তিতে বলীয়ান হয়ে ইনি পুরাতন ভালোবাসার চেনা জায়গাটিতে ফিরে এসে- এখানকার জনগনের সেবা করতে পারেন। ভারতের স্বপ্ন নিবেদিতার স্বপ্ন; ভারতের চিন্তা নিবেদিতায় প্রকাশিত।.......তাঁর রচনাবলীর প্রতিটি ছত্রে ভারতীয় মনকে গ্রহণ ও ধারণ করার কী- না অপূর্ব ক্ষমতা।....ভারতের প্রতি প্রেম তাঁকে দিয়েছিল ভারত বিষয়ে অদ্ভুত অন্তর্দৃষ্টি।'
@Manas Roy- 9734601344

Post a Comment

0 Comments