মেদিনীপুর এর নামকরণ হল কীভাবে

প্রতিটি স্থানের নামের একটি নিজস্ব ইতিহাস থাকে।কোনো  অঞ্চলের স্থানের নামের উৎপত্তি হয় এক জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে।প্রতিটি যুগে স্থানের নাম হিসেবে যে শব্দ গুলি সময়ে সময়ে প্রচলিত হয়ে ওঠে তা থেকেই দেশটির নামের স্থানের বিশেষ চরিত্র সৃষ্টি হয়।
প্রাগৈতিহাসিক যুগে মেদিনীপুর(Midnapore/Medinipur) জেলা নামে ভূখন্ডটি থাকলেও মেদিনীপুর নামে তার কোনো পরিচিতি ছিলনা।এর নামকরণ নিয়েও নানা বিতর্ক ও মত আছে।

মেদিনী মাতার তত্ব:

কেউ কেউ মনে করেন মেদিনী(ধরিত্রী) মাতা থেকে মেদিনীপুর এর নামের উৎপত্তি হয়েছে।ইংরেজ আমলে কোন এক ভদ্রলোক তার জমির পাশে পুরাতন দুর্গের আকারের একটি বিরাট পাথর দেখতে পায়।এই পাথরের গায়ে একটি দেবী মূর্তি খোদিত ছিল।পরে ঐ ভদ্রলোক মূর্তিটি জঙ্গলে ফেলে দেন।কর্নেলগোলার জনৈক রুদ্রনারায়ণ চক্রবর্তী ঐ মূর্তিটি দেখে  মেদিনী মাতার মূর্তি বলে তার ধারণা করেন।

মেদিনী কর এর তত্ব:

মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী একটি পুঁথির উল্লেখ করে বলেন পূর্বে উৎকল দেশীয় মেদিনীকর নামে এক ব্যক্তি এখানে আগমন করে রাজ্য স্থাপন করেন। সম্ভবত তার নাম অনুসারেই মেদিনীপুর হয়েছে।যদিও মেদিনীকর এর রাজ্য সম্পর্কে কোনো ঐতিহাসিক তথ্য নেই।তাই তিনি বলেছেন যে এটা তাঁর অনুমান মাত্র। এ বিষয়ে স্থানীয় গবেষকদের আরো অনুসন্ধান করতে হবে।

মেদিনীপুর গ্রাম তত্ব:

এই জেলার তিনটি থানায় মেদিনীপুর নামে তিনটি গ্রামের নাম পাওয়া যায়।
1.কাঁথি  মহকুমার দীঘা থানায় মেদিনীপুর নামে একটি গ্রাম আছে।
2.তমলুক মহকুমার পাঁশকুড়া থানায় মেদিনীপুর রাতুল্যা নামে একটি গ্রাম আছে।
3.ঝাড়গ্রাম মহকুমার বিনপুর থানায় মেদিনী নামের একটি গ্রাম আছে।

মেদিনীটাঁর তত্ব:

পুরুলিয়া জেলায় মেদিনী টাঁর নামে একটি গ্রাম আছে।টাঁর শব্দেটি মেদিনীপুর কে আদিবাসী বুটপত্তির সমীপে নিয়ে যায়।

মেদিনী রায় তত্ব:

কেউ কেউ মনে করেন মেদিনী রাই নামে কোনো রাজার নাম থেকে মেদিনীপুর নাম হয়েছে।বলে বাহুল্য এই আনুমানিক উৎস সন্ধানে আরো বলা হয়েছে যে, 'চেরপা' দের রাজা মেদিনী রাই এক সময় রাজত্ব করতেন।অধ্যাপক যদুনাথ সরকারের short history of Aurangazeb থেকে জানা যায় যে, চের রা ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে বিহারের পালামৌ জেলার দ্রাবিড় গোষ্ঠীর একটি শাখা।যাদের প্রভাব প্রতিপত্তি মোঘল আমলেই শেষ হয়ে যায়।

মৌলানা মদনী সাহেব এর তত্ব:

ইসলাম প্রসঙ্গ গ্রন্থে মহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন 'মৌলানা মুস্তাফা মদনীকে সম্রাট আওরঙ্গজেব বর্তমান মেদিনীপুর শহরে একটি মসজিদ সম্পর্কিত মহাল ও বহু লাখেয়াজ সম্পত্তি দান করেছেন।এই মৌলানা মদনী সাহেবের নাম হইতেই মদনীপুর নাম হয়, পরে তার অপভ্রঙশ মেদিনীপুর হয়েছে'। যদিও এই তত্বও প্রমনাভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।

সুকুমার সেন এর ব্যাখ্যা:

'বাংলা স্থাননাম' গ্রন্থের লেখক ড.সুকুমার সেন ব্যাখ্যা দিয়েছেন , 'মেদিনীপুর এর প্রথম অংশ ফারসি ময়দান(খোলা মাঠ)। এই স্থানে সম্ভ্রান্ত মুসলমান বংশের বাস ছিল।তারা হয়ত অন্য স্থান থেকে চলে আসতে বাধ্য হয়েছিল।এই নামটিতে মদিনা নামের প্রভাব থাকতে পারে।'

মেদ জাতি তত্ব:

অনেকে বলেন মেদ নামক উপজাতিদের নাম থেকেই নাকি মেদিনীপুর এর নামকরণ হয়েছে।এই মেদ উপজাতির অস্তিত্ব এখনো মেদিনীপুর জেলার ঝাড়গ্রাম মহকুমার মানিকপাড়া সংলগ্ন খাল শিউলি অঞ্চলে পাওয়া যায়।বিনপুর থানার মেদনি গ্রাম নামটি মেদ উপজাতির প্রাচীনত্বর স্মৃতি স্বরূপ।যদিও এই মেদ উপজাতির আদি ইতিহাস,অবস্থান ইত্যাদি বিষয়গুলো নৃতাত্বিক গনের গভীর অনুসন্ধানের বিষয়।

মিধুনপুর তত্ব:

মেদিনীপুর জেলার প্রত্ন সম্পদ গ্রন্থের লেখক প্রণব রায় এর মতে'মিধুনপুর দন্তভুক্তির রাজধানী ছিল।পরবর্তীকালে মুসলমান বসতির আধিক্যের জন্য মদিনা প্রভাবের ফলে মদিনীপুর ও পরে মেদিনীপুর রূপান্তরিকরণ সম্ভবপর'।এই মিধুনপুর তত্বটি তিনটি কারনে আগ্রহোদ্দীপক।
১. এই তত্ত্বটি তামরুশাসন পটের প্রমাণের উপরের প্রতিষ্ঠিত।
2.মিধুন পুর এর পুর নামক অনার্য শব্দটি দ্রাবিড়িয় প্রভাবান্বিত।
৩.আদিবাসী ব্যুৎপত্তিগত বিশ্লেষণে মেদ/মেধ উপজাতির প্রভাব মিধুনপুর নামকরণে প্রাধান্য বিস্তার করতে পারে।


মেদিনীপুর নামকরণের পুরাতন অভিমত, তত্ত্বগুলো প্রমনাভাবে আসিদ্ধ। তৎকালীন জাতি, উপজাতি সমৃদ্ধ স্থান থেকেই এই ধরনের নামকরণ সম্ভব। মেদ,বাগদী,ডোম,চন্ডাল প্রভৃতি অন্ত্যজ শ্রেণীদের প্রাধান্য ও পুর শব্দের অনার্য ব্যুৎপত্তি একটা তৎকালীন বিশ্লেষণের প্রচেষ্টা মাত্র।এই ধরনের আদিবাসী ব্যুৎপত্তিমূলক লোকায়ত বিশ্লেষণের মাধ্যমে যত দ্রুত একটা সঠিক সিদ্ধান্তে আসা যায় এই বিভ্রান্তির ধুম্রজাল তত শীঘ্র দূর হবে এবং তা হবে বাংলার স্থান নামের ইতিহাসে একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য সংযোজন।

Post a Comment

0 Comments