চুয়াড় বিদ্রোহ : পরাধীন ভারতবর্ষের প্রথম ইংরেজ বিরোধী প্রতিবাদ আন্দোলন (Chuar Rebellion-1799)



চুয়াড় বিদ্রোহ : পরাধীন ভারতবর্ষের প্রথম ইংরেজ বিরোধী প্রতিবাদ আন্দোলন

প্রকৃত পক্ষে চুয়াড় বলে কোনো জাতির অস্তিত্ব নেই।সাধারণত অসভ্য, বর্বর,অমার্জিত,গোঁয়ার প্রকৃতির মানুষকে গালাগালি বা অবহেলা প্রদর্শনের জন্য চুয়াড় বলা হয়ে থাকে। যদিও ইংরেজরা কেবল জঙ্গল মহলের রাজার পাইক প্রজা এবং ভূমিজ, মুন্ডা, সাঁওতাল, কুর্মী, বাগদি, বাগাল, মাঝি প্রভৃতি প্রতিবাদী নিম্ন বর্ণের জনগোষ্ঠীর লোকেদেরই চুয়াড় বলে অভিহিত করেছে। এরা তাদের গড়রাজা বা তাদের প্রতিনিধি ভিন্ন ইংরেজ কর্মচারীদের কথা শুনত না এবং তথাকথিত সভ্যদের মত জো হুজুর বলে উচ্চ শ্রেণীর আদব কায়দা প্রদর্শন করতে জানত না বলেই তারা ইংরেজদের কাছে চুয়াড়। জঙ্গল মহলে কোম্পানি নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এই সমস্ত পাইক ও বরকন্দাজদের তাদের পূর্বর্জিত অধিকার থেকে উচ্ছেদ করতে চাইলে, তারা কোম্পানির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে লড়াই করেছিল বলে ইংরেজরা তাদের ঘৃণা ও অবহেলা ভরে চুয়াড় আখ্যা দেয়।১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ কোম্পানি মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের কাছ থেকে দেওয়ানি লাভ করে। ১৭৬৬ সালের মার্চ মাসে উত্তর পশ্চিম ও পশ্চিম অংশের জঙ্গল রাজাদের দমন করে তাদের কর প্রদানে বাধ্য করার জন্য এবং তাদের দুর্গ গুলো অধিকার করে শক্তির উৎসকে যথা সম্ভব নির্মূল করার জন্য ইংরেজ সরকার জঙ্গল মহলে সেনা অভিযান করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১৭৬৭ সালের জানুয়ারি মাসে মেদিনিপুরের রেসিডেন্ট গ্রাহামের নির্দেশে এনসাইন ফারগুসন এর নেতৃত্বে প্রায় চার কোম্পানি সিপাহি এবং কয়েকজন ইউরোপীয় সার্জেন্ট এই অভিযানে অংশ নেয়।  একে একে সকল জমিদার বশ্যতা স্বীকার করলেও ধলভুমের রাজা বশ্যতা স্বীকার করেন নি। ফারগুসন অনুগত জমিদারদের সঙ্গে আলোচনা করে বৃদ্ধ রাজার ভাইপো জগ্ননাথ ধল কে ধলভুমের রাজা করে দেন। বৃদ্ধ ধলভুম রাজাকে মাসহারায় মেদিনিপুরে নির্বাসিত করা হয় এবং সেখানেই তার মৃত্যু হয়। এর ফলে আপাতত বিদ্রহের আগুন নির্বাপিত হয়। কিন্তু ফারগুসন চলে আসার অব্যবহিত পরেই জগ্ননাথ ধল রাজস্ব আদায় দিতে অস্বীকার করেন। ইতিমধ্যে ১৭৬৭ সালে ভ্যান্সিস্টারট মেদিনিপুরের রেসিডেন্ট নিযুক্ত হয়ে ক্যাপ্টেন রুর কে পাঠালেন জগ্ননাথ কে গ্রেপ্তার করার জন্য। কিন্তু জগন্নাথ কে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হল না। জগন্নাথের পর একে একে অযোধ্যারাম, লড্ডর সিং, মানগোবিন্দ, প্রমুখ জমিদার রাজস্ব দিতে অস্বীকার করে এবং ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রহ ঘোষণা করে। বরাভুম, সিংভুম, রায়পুর, বগড়ি, ও কর্ণগড়ের সর্দার লাল সিং, দুর্জন সিং, গোবর্ধন দিকপতি, রানি শিরোমণি এবং জগন্নাথ ধলের নেতৃত্বে সমস্ত জঙ্গল মহলে শুরু হল প্রবল ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন। ১৭৯৮ সালে ১৫০০ জমিহীন পাইক রায়পুরের কাছারি পুড়িয়ে দিল ও একই সময়ে গোবর্ধন দিকপতি চন্দ্রকোনায় ইংরেজ দের আক্রমণ করল। ১৭৯৯ সালে বগড়ি থেকে সিংভুম, বরাভুম থেকে ম্যুরভঞ্জ পর্যন্ত সমগ্র জঙ্গল মহলে ইংরেজ বিরোধী প্রতিবাদ আন্দোলন ভয়ংকর আকার ধারন করল। ইংরেজরা এর নাম দিলেন চুয়াড় বিদ্রোহ। জঙ্গল মহলের বিক্ষুব্ধ সমস্ত জনজাতির মানুষ পাইকদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রতিবাদের অগ্নিবলয় রচনা করল। কোম্পানি ১৭৯৯ সালের ৬ এপ্রিল চুয়াড় দের মন্ত্রণা দাতা সন্দেহে কর্ণ গড়ের রানিকে বন্দি করল। আন্দোলনকারী পাইকরা বিভিন্ন জায়গায় হামলা চালাল। কোম্পানির পক্ষ থেকেও শুরু হল ব্যপক ধরপাকড়। কিন্তু কোম্পানির পুলিশ এবং সিপাহীরা স্থানীয় পাইক বরকন্দাজদের সঙ্গে পেরে উঠল না।কোম্পানি দেখল জমিদার ও পাইক দের জমি দখল করতে গিয়ে আয় যা হয়েছে ব্যয় হয়েছে তার বহুগুন। এই কারনে এক আদেশ বলে অবশেষে চুয়াড় -পাইক দের নিষ্কর জমি ফিরিয়ে দেওয়া হল।  জমিদাররা যে যতটুকু নিষ্কর জমি ভোগ করতেন তা তাদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া হল। ১৭৬৫ থেকে ১৭৯৩ সাল পর্যন্ত অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় এবং জমি ব্যবস্থা নিয়ে নানারকমের পরীক্ষা করার পরে ১৭৯৯ সালে ঝাড়গ্রামে প্রচলিত সনাতন জমি ব্যবস্থা পুনরায় কায়েম করে সাময়িক ভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা হল। রাজনৈতিক বন্দিদের ক্ষমা করা হল। ১৮০০ সালে তথাকথিত চুয়াড় বিদ্রোহের আপাতত অবসান ঘটল। 

চুয়াড় বিদ্রোহই ছিল পরাধীন ভারতবর্ষের প্রথম ইংরেজ বিরোধী প্রতিবাদ আন্দোলন। স্বাধীনতা যুদ্ধের মত ব্যপ্তি বা বিশালতা না থাকলেও এটাই সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজদের বিরুদ্ধে দেশজ মানুষের অধিকার অর্জনের প্রথম সংগ্রাম। রাজা জমিদারেরা পেছন থেকে এই আন্দোলন পৃষ্ঠপোষকতা করলেও যুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছিল জঙ্গলমহলের তথাকথিত অশিক্ষিত, অসভ্য, অধিবাসীরাই। আর ইংরেজদের ঘুম কেড়ে নেওয়া ৩৪ বছরের লড়াই যখন থামল , তখন ঝুপ করে সন্ধ্যা নামার মতই ঝারগ্রাম ফিরে গিয়েছিল ঝারগ্রামের প্রথাবদ্ধ জীবনে।  


Post a Comment

0 Comments