সাঁওতাল,মুন্ডা, হো,ওরাং,চুয়াড়
প্রভৃতি উপজাতি সম্প্রদায়ের নাম
শুনেছেন বা তাদের পরিচয়
আপনি জানেন। আজ
আপনাদের পরিচয় করাব একটি
নতুন উপজাতি সম্প্রদায়ের সাথে। যাদের
বলা হয় হাজং।
কাচারি শব্দ হাজো থেকে হাজং
শব্দের উৎপত্তি হয়েছে বলে অনেকে
মনে করে থাকেন।নৃ-বিজ্ঞানীদের মতে,
এই হাজংদের আদিনিবাস উত্তর বার্মায়।
প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে হাজংদের পূর্বপুরুষের
দলটি তাদের আদিনিবাস ত্যাগ
করে ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় পার্বত্য
এলাকায় প্রথমে প্রবেশ করে
। পরবর্তীকালে তারা
সে স্থান পরিত্যাগ করে
আসামের কামরূপ জেলার হাজো
নামক স্থানে বসতি স্থাপন
করে । এই
হাজো থেকেই হাজং শব্দের
উৎপত্তি। সপ্তদশ
শতকে মুঘলদের দ্বারা বিতাড়িত হয়ে
হাজংরা গারো পাহাড়ে আশ্রয়
নেয় এবং পরে সমতলভূমিতে
বসতি স্থাপন করে।
হাজংদের
দৈহিক গঠন মধ্যমাকৃতি ।
দেহ হূষ্টপুষ্ট ও মাংশল ।
মাথার চুল ঘন ও
কালো। তারা
বেশ হাসিখুশি স্বভাবের হয়ে থাকে ।
তাদের দেহে মঙ্গোলীয় ছাপের
উপস্থিতি খুব বেশি পরিলক্ষিত
হয় না, বরং দক্ষিণপূর্ব
এশিয়ায় বসবাসকারী বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর দৈহিক ছাপের প্রাধান্য
পরিলক্ষিত হয় । বর্তমানে
বাংলাদেশে বসবাসকারী হাজংদের প্রধান ভাষা বাংলা। হাজং
ছেলেমেয়েরা বাংলা ভাষাতেই বিদ্যালয়ে
পাঠ গ্রহণ করে এবং
অন্য সমাজের লোকজনের সঙ্গে
হাজংরা বাংলা ভাষাই ব্যবহার
করে । হাজংদের
নিজস্ব ভাষা রয়েছে ।
এটি তারা নিজেদের মধ্যেই
ব্যবহার করে। হাজং
ভাষার নিজস্ব কোনো বর্ণমালা
নেই । হাজংরা
ভাষার লিখিত রূপ দিতে
অসমীয়া বর্ণমালা ব্যবহার করে।
হাজং নারীরা যে কাপড়
পরিধান করে সেটিকে তারা
‘পাথিন’ বলে। পাথিন
বিভিন্ন রংয়ের সংমিশ্রণে তাঁতে
বোনা ডোরাকাটা মোটা কাপড়, যা
দৈর্ঘ্যে সাড়ে তিন হাত
এবং প্রস্থে আড়াই হাত হয়ে
থাকে । হাজং
নারীরা বক্ষবন্ধনী হিসাবেও এটি ব্যবহার করে
। হাজং মহিলারা
শীতকালে এক ধরনের নিজস্ব
ঢংয়ে বোনা চাদর ব্যবহার
করে সেটিকে তারা আর্গন
বলে । এছাড়া
কাজের সময় বিশেষ করে
আমন ক্ষেতে চারা বপনকালে
হাজং মহিলারা এক ধরনের কোমরবন্ধনী
ব্যবহার করে যা বানং
নামে পরিচিত । হাজংরা
সাধারণত বাঁশ, কাঠ, শণ
প্রভৃতির সাহায্যে বসতঘর নির্মাণ করে। ঘরগুলি
তারা সাধারণত চৌচালা নির্মাণ করতেই
পছন্দ করে । প্রতিটি হাজং বাড়িতে ছোট
করে হলেও সৃষ্টিকর্তাকে প্রণাম
জানানোর জন্য আলাদা একটি
ঘর নির্মাণ করে। হাজংরা
সেটিকে ‘দেওঘর’ বলে । প্রতি
সন্ধ্যায় হাজংরা দেওঘরে প্রদীপ
জ্বালিয়ে ধুপধুনা পুড়িয়ে সৃষ্টিকর্তাকে প্রণাম করে ।
আমিষ ভোজী হাজংদের প্রধান
খাদ্য ভাত । তারা
মাছ খেতে পছন্দ করে। তারা
বিভিন্ন পশুপাখির মাংস যেমন পাঁঠা,
হরিণ, শুকর, ভেড়া, মুরগি,
হাঁস, কবুতর ও কচ্ছপের
মাংস খেতে পছন্দ করে
। বিন্নী চালের
ভাত এবং শুঁটকি মাছ
তাদের প্রিয় । হাজং
সমাজে পঁচুই মদের প্রচলন
রয়েছে। বিভিন্ন
সামাজিক অনুষ্ঠান এবং উৎসবাদিতে পঁচুই
মদের বেশ ব্যবহার হয়
। হাজং নারীরা
পৌষ ও চৈত্রসংক্রান্তিতে বিভিন্ন
ধরনের পিঠা তৈরি করে
এবং এইগুলির নাম মুছি পিঠা,
পুনি পিঠা, পাতি পিঠা,
ডিক্রি পিঠা, চা পিঠা
ইত্যাদি।
হাজং সমাজ পিতৃতান্ত্রিক।
পরিবারে পিতাই মূল নিয়ন্ত্রক
এবং মায়ের অবস্থান সেখানে
দ্বিতীয়। পারিবারিক
সম্পত্তির উত্তরাধিকারী ছেলেরা । কোনো
বিধবা হাজং মহিলা যদি
পুনর্বিবাহ না করেন, তবে
তিনি তার স্বামীর সম্পত্তির
অধিকারী হন। হাজংরা
যৌথ পারিবারে বাস করে।
তবে বর্তমানে অনেকেই একক পরিবার
গঠনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। সমাজ
পরিচালনায় সমগ্র হাজং অঞ্চল
চারটি ভাগে বিভক্ত ।
(১) কয়েকটি পরিবার নিয়ে একটি
পাড়া; (২) কয়েকটি পাড়া
নিয়ে একটি গাঁও; (৩)
কয়েকটি গাঁও-এর সমন্বয়ে
একটি চাক্লা গঠিত হয়
এবং (৪) কয়েকটি চাক্লা
নিয়ে একটি পুরাগাঁও বা
পরগনা গঠিত হয়।
গ্রামের
বয়স্ক, স্বচ্ছল ও বিজ্ঞ ব্যক্তিকে
গাঁওবুড়া বা গ্রাম প্রধান
নির্বাচন করা হয়।
তিনি তাঁর অধীনস্থ গ্রামের
শান্তি-শৃঙ্খলা নিশ্চিত করেন । গাঁওবুড়াদের
সম্মিলিত সিদ্ধান্তে সড়ে মোড়ল বা
চাক্লা প্রধান নিযুক্ত হয়ে
থাকেন। বর্তমানে
পুরাগাঁও বা পরগনা প্রধানের
কোনো অস্তিত্ব নেই । গাঁওবুড়া
নির্বাচিত হন স্থায়ীভাবে এবং
এক গাঁওবুড়ার মৃত্যুর পরই অন্য আরেক
জনকে শূন্যপদে নির্বাচন করা হয়।
সড়ে মোড়ল বা চাক্লা
প্রধানকে নির্বাচন করা হয় অস্থায়ীভাবে
এবং কোনো অনিয়মজনিত কারণে
গাঁওবুড়াগণ সম্মিলিত সিদ্ধান্তে তাঁকে পদচ্যূত করতে
পারেন। এলাকার
শান্তি-শৃঙ্খলা বিধানসহ সমাজের বিভিন্ন কার্যক্রম
পরিচালনায় গাঁওবুড়া ও সড়ে মোড়ল-এর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। যে
কোনো ব্যক্তি ইচ্ছামতো একগ্রাম থেকে অন্য গ্রামে
গিয়ে বসতি স্থাপন করতে
পারে না । এক্ষেত্রে
তাকে নিজ গ্রামের গাঁওবুড়ার
অনুমতি গ্রহণ করতে হয়
এবং গাঁওবুড়া একা সেই সিদ্ধান্ত
দিতে পারেন না ।
তাঁকে তাঁর গ্রামের দশজন
প্রধান ব্যক্তির পরামর্শ ও মতামত নিতে
হয়। যে
ব্যক্তি নিজ গ্রাম ছেড়ে
অন্য গ্রামে যাবে তাকে
তার গ্রামের গাঁওবুড়াকে কিছু আর্থিক জরিমানা
প্রদান করতে হয়।
হাজংরা সেটিকে ‘মাটি নিদাবি’ বলে
। আবার যে
গ্রামে সে বসবাস করবে
সেই গ্রামের গাঁওবুড়াকেও কিছু আর্থিক অনুদান
প্রদান করতে হয়।
হাজংরা সেটিকে গাঁও হামাকর
বলে। গাঁও
হামাকর পরিশোধ না করা
পর্যন্ত ঐ ব্যক্তি সেই
গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি লাভ করে
না।
হাজং সমাজ ১৭টি নিকনী
বা গোত্রে বিভক্ত ছিল। এগুলি
হলো পোড়াচুঙা, চন্ডি, বাটাজোর, বালিহাটা,
কেন্দগাঁও, তারাগাঁও, জিগনীগাঁও, কাটলেগাঁও, বগিগাঁও, কামাক্ষা, খারুগাঁও, সোনামই, ছাতীগাঁও, কমলীগাঁও, ঘোড়াবালি, পরশমনি এবং আখিগাঁও।
বর্তমানে হাজং সমাজে এসব
নিকনীর অস্তিত্ব বিলুপ্তপ্রায়। বর্তমানে
নিকনীর পরিবর্তে হাজং সমাজে হিন্দুদের
অনুকরণে কাশ্যপ, ভরদ্বাজ, শান্ডিল্য, অসত্বানন্দ প্রভৃতি গোত্রনাম ব্যবহার শুরু হয়েছে।
তারা এখন রায়, দাস,
সরকার পদবিতে পরিচিত হতে
স্বাচ্ছন্দ বোধ করে।
একবিবাহ হাজং সমাজে স্বীকৃত
প্রথা, তবে প্রথম স্ত্রীর
অনুমতিক্রমে পুরুষ দ্বিতীয় বিবাহ
করতে পারে। ছেলেমেয়ে
বয়ঃপ্রাপ্ত হলে হাজং অধিকারীর
নিকট দীক্ষামন্ত্র নিতে হয়। বিয়ের
আলোচনা শুরুর পূর্বে পাত্রপাত্রীর
গোত্র অনুসন্ধান করা হয়। একই
নিকনী বা গোত্রে হাজং
সমাজে বিয়ে হতে পারে
না। বরের
পিতৃগৃহেই বিবাহ কাজ সম্পন্ন
হয় এবং নব দম্পতি
সেখানেই বসবাস শুরু করেন। হাজং
সমাজে বিধবা বিবাহের প্রচলন
আছে।
হাজংরা
ধর্মবিশ্বাসে হিন্দু হলেও তাদের
কিছু নিজস্ব আদি বিশ্বাস
আছে যা তারা স্বতন্ত্রভাবে
পালন করে এবং এক্ষেত্রে
তারা অন্যান্য বাঙালি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের
আচার-আচরণ ও উপাসনা
পদ্ধতি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। হাজংরা
উপাসনাভেদে দুই সম্প্রদায়ে বিভক্ত। একটি
হাজং অপরটি খাটাল।
হাজংরা শক্তির উপাসক আর
খাটালরা ভক্ত অর্থাৎ বৈষ্ণবপন্থি্। উভয়
মতবাদে বিশ্বাসী হাজং সম্প্রদায় সরস্বতী,
লক্ষ্মী, কালী বা শ্যামা,
দুর্গা, কামাক্ষা, মনসা প্রভৃতি দেবীর
পূজাঅর্চনা করে থাকে।
এক্ষেত্রে শাক্ত দলের হাজংরা
ব্রাহ্মণ পুরোহিতের সাহায্য গ্রহণ করে এবং
বৈষ্ণব অর্থাৎ ভক্ত দলের
হাজংরা নিজ সমাজের অধিকারীদের
সাহায্যে পূজাপার্বনের কাজ সম্পন্ন করে। উভয়
সম্প্রদায়ই দুর্গাপুজা বারোয়ারি আয়োজনের মাধ্যমে সম্পন্ন করে। এছাড়া কালী পূজার
সময়ে তারা উৎসবের আয়োজন
করে। সে
সময় শাক্ত দলের পূজারীরা
পশুবলি এবং ভক্ত দলের
পূজারীরা ফুল, ফল, জল
এবং নৈবেদ্য উৎসর্গের মাধ্যমে পূজার কাজ সম্পন্ন
করে। হাজংদের
নিজস্ব দেবদেবী রয়েছে যেমন বাস্ত্তদেবী
হচ্ছে রক্ষাকর্ত্রী, সম্পদদাত্রী ও রোগশোকের নিরাময়কারিনী। বাস্ত্তদেবীর
জন্য নির্দিষ্ট স্থান বা নির্দিষ্ট
দেবীমূর্তি থাকেনা সেখানে কেবল
একটি পরিচ্ছন্ন বেদী থাকে।
সেখানে তারা পূজা উৎসর্গ
করে।
গৃহদেবতার জন্য নির্দিষ্ট মন্দিরকে
হাজংরা দেওঘর নামে অভিহিত
করে এবং সেখানে হাজংরা
হয়গ্রীব তথা বিষ্ণু দেবতার
পূজা করে থাকে। এসমস্ত
দেবদেবী ছাড়াও হাজংদের আরো
দেবদেবী রয়েছে এবং সেগুলি
বিভিন্ন নামে পরিচিত যেমন
খাংখাঙী দেও, ময়লাদেও, হাওয়াদেও,
পিঠাদেও ও গাঙদেও।
হাজংরা খাংখাঙী দেবীর উপাসনা করে
শত্রুর কবল থেকে রক্ষা
পাওয়ার উদ্দেশ্যে।
নবজাত
শিশুর মঙ্গল কামনায় হাজংরা
ময়লাদেওয়ের পূজা করে থাকে।
নবজাত শিশু অসুস্থ হয়ে
পড়লে এই দেওয়ের উদ্দেশ্যে
মানত করা হয় এবং
শিশু সুস্থ হয়ে উঠলে
শ্যাওড়া গাছের নিচে ঢেঁকি
ছাঁটা চাল, বিচিকলা, গুড়
প্রভৃতি ময়লাদেওয়ের উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হয়। পারিবারিক
সমৃদ্ধির উদ্দেশ্যে হাওয়াদেওকে হাজংরা পূজা করে
থাকে। সর্বাঙ্গে
খোসপাঁচড়াসহ মারাত্মক ধরনের ঘা দেখা
দিলে হাজংরা পিঠাদেওয়ের উদ্দেশ্যে
মানত করে এবং মানত
পূরণ হলে নির্দিষ্ট দিনে
শুদ্ধদেহে সুস্বাদু পিঠা প্রস্ত্তত করে
সেই পিঠা দিয়ে উক্ত
দেওয়ের পূজা সম্পন্ন করে। ছোট
ছেলেমেয়েরা যদি জ্বরে ভোগে
এবং হলুদ বর্ণের বমি
এক নাগাড়ে করে তাহলে হাজংরা
গাঙদেওয়ের উদ্দেশ্যে পূজা নিবেদন করে। এই
দেওয়ের পূজায় হাজংরা হাসের
ডিম নৈবেদ্য হিসেবে উৎসর্গ করে
। হাজংরা
জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী। কর্মফল
অনুযায়ী পুনর্জন্মে তারা বিশ্বাস করে
। হাজংরা গীতা,
বেদ, রামায়ণ প্রভৃতি ধর্মগ্রন্থ পাঠ করে থাকে। হাজং
ও খাটাল এই দুই
সম্প্রদায়ের মধ্যে হাজংরা মদ
পান করে, খাটালরা মদ
পান করে না।
হাজংরা মৃতদেহ দাহ করে। মৃত
ব্যক্তির পুত্রসন্তানেরাই মুখাগ্নি করে এবং তারা
অশৌচকাল পালন করে।
অশৌচকাল পালন শেষে তারা
মৃতব্যক্তির আদ্যশ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান করে । গঙ্গাবক্ষে
দেহভস্ম বিসর্জনও তাদের পারলৌকিক ক্রিয়াকর্মের
অন্যতম। এদেশের
হাজং সমাজ স্বেচ্ছাচারী জমিদারদের
বিরুদ্ধে প্রথম হাতিখেদা আন্দোলন
করে। ব্রিটিশ
বিরোধী আন্দোলনেও তারা উল্লেখযোগ্য অবদান
রাখে।তাদের
পরিচালিত একটি উল্লেখযোগ্য আন্দোলন
হল টঙ্ক আন্দোলন।
ময়মন সিং জেলায় এই
আন্দোলন শুরু হয়, প্রায়
৫০০০ হাজং উপজাতি টঙ্ক
বা খাজনার পরিমাণ হ্রাস
এবং ফসলের বদলে টাকা
দেওয়ার দাবী জানায়।
পুলিশ হাজংদের গ্রেপ্তার করে। এরপর
১৯৪৭ সালে জানুয়ারি মাসে
পুলিশের সঙ্গে হাজংদের সশস্ত্র
সংঘর্ষ বাধে।
0 Comments