পন্ডিতা রমাবাঈ স্মরণীয় কেন

প্রাচীন যুগ থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত ভারতীয় নারীর অবস্থা বহু পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গেছে। প্রাচীণযুগ থেকে মধ্যযুগে তাদের অবস্থার অবনতি, আবার আধুনিক যুগে কয়েকজন সমাজসংস্কারকের প্রচেষ্টায় সমমর্যাদার অধিকারে উত্তরণের ইতিহাস বেশ ঘটনাবহুল। আধুনিক ভারতে নারীরা রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, লোকসভার অধ্যক্ষ, বিরোধী দলনেতা, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্যপাল সহ বহু গুরুত্বপূর্ণ পদ অলংকৃত করেছেন।2018 সালে ভারতের রাষ্ট্রপতি, লোকসভার(সংসদের নিম্নকক্ষ) অধ্যক্ষ, লোকসভার বিরোধী দলনেতা তিনটি পদই অলংকৃত করেন মহিলারা। যদিও আজও কিছু কিছু ক্ষেত্রে মহিলারা লিঙ্গবৈষম্য অপরাধের শিকার।

উনিশ শতকে নারীশিক্ষাকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু নারীও উদ্যোগী হয়েছিলেন। এদের মধ্যে পশ্চিম ভারতেপণ্ডিতা রমাবাঈ, মাদ্রাজে ভগিনী শুভলক্ষ্মী বাংলায় বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন বিশেষ উল্লেখযোগ্য। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ভাগে ব্রিটিশ প্রশাসন মেয়েদের শিক্ষার আওতায় আনার জন্য বিভিন্ন অনুদান বৃত্তি দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল। তার ফলে নারীশিক্ষার কিছুটা বিকাশ ঘটে। | পণ্ডিতা রমাবাঈ ছিলেন ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে। প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্র বিষয়ে তার পড়াশোনা ছিল। সমস্ত সামাজিক বাধা নস্যাৎ করে তিনি এক শূদ্রকে বিয়ে করেন। পরে বিধবা অবস্থায় নিজের মেয়েকে নিয়ে ইংল্যন্ডে গিয়ে ডাক্তারি পড়েন। রমাবাঈ বিধবা মহিলাদের জন্য একটি আশ্রম তৈরি করেছিলেন। তবে রমাবাঈয়ের উদ্যোগকে রক্ষণশীলদের অনেকেই সমালোচনা করেছিলেন।

পণ্ডিতা রমাবাঈ ১৮৫৮ সালের ২৩ এপ্রিল মারাঠি ভাষী ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।তাঁর বাল্য নাম ছিল রমা ডোংরে তাঁর বাবা ছিলেন সংস্কৃত পণ্ডিত অনন্ত ডোংরে। ১৮৭৬-৭৮ এর মহা দুর্ভিক্ষের সময় ১০ বছর বয়সে অনাথ হয়ে রমাবাঈ এবং তার ভাই দোংরে সংস্কৃত শিক্ষার জন্য ভারতে ভ্রমণ করেন। প্রভাষক হিসাবে রমাবাঈয়ের খ্যাতি কলকাতায় পৌঁছালে, সেখানকার পণ্ডিতেরা তাঁকে বক্তব্য রাখার জন্য আমন্ত্রণ জানান। ১৮৭৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় রমাবাঈকে সংস্কৃত রচনায় পাণ্ডিত্যের স্বীকৃতি হিসাবে পণ্ডিতা এবং সরস্বতী উপাধিতে ভূষিত করে। একেশ্বরবাদী সংস্কারক কেশবচন্দ্র সেন তাঁকে হিন্দু সাহিত্যের পবিত্রতম সাহিত্য বেদের অনুলিপি প্রদান করেন এবং রমাবাঈ সেগুলি পড়তে উৎসাহিত হন। ১৮৮০ সালে শ্রীনিবাসের মৃত্যুর পর, রামবাঈ এক বাঙালি আইনজীবী বিপিন বিহারী মেধ্বীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বর ছিলেন একজন বাঙালি কায়স্থ। তাই বিবাহটি আন্তঃবর্ণ ছিল এবং তাই সে সময়ে যথেষ্ট আলোচিত হয়। ১৮৮০ সালের ১৩ নভেম্বর একটি নাগরিক অনুষ্ঠানে তাদের বিয়ে হয়েছিল। এই দম্পতির একটি কন্যা সন্তান হয় যার নাম ছিল মনোরমা। ১৮৮২ সালে মেধ্বীর মৃত্যুর পর, ২৩ বছর বয়সী রমাবাঈ পুনে চলে আসেন এবং মহিলাদের শিক্ষার প্রচারের জন্য গঠন করেন আর্য মহিলা সমাজ (আর্য মহিলা সমিতি)

রমাবাঈ ১৮৮৩ সালে মেডিকেল শিক্ষার জন্য ব্রিটেনে যান; কিন্তু বধিরতার কারণে তিনি প্রত্যাখ্যাত হন। বিট্রেন থাকাকালীন তিনি খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেন। ১৮৮৬ সালে তিনি তার আত্মীয় এবং প্রথম মহিলা ভারতীয় ডাক্তার, আনন্দবাই যোশীর স্নাতকোত্তর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আমেরিকা যান। সেখানে দুই বছর অবস্থান কালে পাঠ্যপুস্তকের অনুবাদ করেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কানাডায় বক্তৃতা প্রদান করেন। সেখানে তিনি তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বই ' দ্য হাই-কাস্ট হিন্দু ওম্যানইংরেজিতে প্রকাশ করেন। রমাবাই এই বইটি উৎসর্গ করেছিলেন, উচ্চ-বর্ণের হিন্দু মহিলা, আরও নির্দিষ্ট করে বললে ব্রাহ্মণ মহিলা ডাঃ আনন্দীবাঈ যোশীর উদ্দেশ্যে, ব্রিটিশ ভারতে হিন্দু নারী জীবনের অন্ধকার দিক দেখিয়ে হিন্দু শিশু, কন্যা বিধবা মহিলাদের উপর নিপীড়নের প্রতিরোধের চেষ্টা করেছেন।

 ১৮৯৬ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময়, রমাবাঈ গরুগাড়ীতে করে মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন গ্রাম ভ্রমণ করেছেন এবং হাজার হাজার পরিত্যাক্ত, অনাথ শিশু এবং নিঃস্ব মহিলাদের উদ্ধার করে তাদের মুক্তি মিশন সারদা সদনে আশ্রয় দান করেন। তিনি সাতটি ভাষায় দক্ষ একজন শিক্ষিত মহিলা যিনি মূল হিব্রু এবং গ্রীক থেকে তাঁর মাতৃভাষামারাঠিতে বাইবেলের অনুবাদ করেছেন।

১৯৮৮ সালের ২৬ অক্টোবর, ভারতীয় মহিলাদের অগ্রগতিতে তার অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ, ভারত সরকার একটি স্মারক ডাকটিকেট জারি করে।মুম্বাইয়ের একটি রাস্তার নামও রাখা হয়েছে তাঁর সম্মানে।

আরও পড়ুন- কলকাতা রাইটার্স বিল্ডিং এর অজানা কাহিনী 👈



Post a Comment

0 Comments