১৯০৬ সালে যুগান্তর পত্রিকায় এক সম্পাদকীয়তে লেখা হলঃ “দেশের ৩০ কোটি মানুষ যদি তাদের ৬০ কোটি হাত প্রতিরোধের প্রতিজ্ঞায় তুলে ধরে তবেই বন্ধ হবে এ অত্যাচার। একমাত্র শক্তি দিয়েই শক্তির প্রকাশকে স্তব্ধ করা সম্ভব।” বিশ শতকের প্রথম দশক থেকেই ব্রিটিশ শাসনের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল এই প্রতিরোধের মেজাজ।
অনেকে বলে থাকেন যে, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অহিংস আন্দোলনের ভূমিকাটাই প্রধান, সশস্ত্র বিপ্লবীদের কোনো ভূমিকাই ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে ছিল না। এই বক্তব্যকে পুরপুরি মেনে নেওয়া যায়না। খোলা মন নিয়ে ইতিহাসের পাতা উলটালেই দেখা যাবে যে, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সশস্ত্র বিপ্লবীদের বিরাট ভূমিকা ছিল।ভারতে জাতীয় কংগ্রেসের হাত ধরে জাতীয় আন্দোলনের সুচনা হয়েছিল একথা সত্য কিন্তু প্রথম যুগের কংগ্রেস নেতাদের লক্ষ্য ছিল আবেদন নিবেদন নীতির মাধ্যমে কিছু দাবিদাওয়া আদায় করা এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মধ্যেই ডমিনিয়ন স্ট্যাটাস লাভ করা।তাঁরা বলতেন যে, এই ডমিনিয়ন স্ট্যাটাস লাভ করার জন্য আবেদন নিবেদনের পথে অগ্রসর হতে হবে পিটিশনের মাধ্যমেই ডমিনিয়ন স্ট্যাটাস লাভ করতে হবে। যদিও শেষ পর্যন্ত কংগ্রেসকে আবেদন-নিবেদন স্তরে আটকে রাখা সম্ভব হয়নি। কংগ্রেসের মধ্যেই আবির্ভাব ঘটল লোকমান্য তিলক, বিপিনচন্দ্র পাল, লালা লাজপত রায়ের মতো নেতার যাঁরা ভারতকে শোনালেন বিদ্রোহের বাণী।
তাঁরা যখন দেশবাসীকে বিদ্রোহের বাণী শোনাচ্ছিলেন তখন ভারতের মাটিতে বিপ্লবের বার্তা নিয়ে এলেন অরবিন্দ ঘোষ।অরবিন্দের শিক্ষাদীক্ষা ইংল্যান্ডে। চোদ্দ বছর বয়স (১৮৮৬) থেকে তিনি দেশের স্বাধীনতার কথা চিন্তা করতে থাকেন এবং আঠারো বছর বয়সে পৌঁছানোর মধ্যেই তাঁর মনে এই বিশ্বাসই দৃঢ় হয়ে ওঠে যে, ব্রিটিশ শাসনের দাসত্ব শৃঙ্খল থেকে ভারতের মুক্তি বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে অর্জন করতে হবে। ফরাসি বিপ্লবের ভাবধারায় তিনি উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠেন। ফরাসি বিপ্লবের নেতা দাঁতে এবং রোবসপিয়ার তাঁর জীবনে গভীর প্রভাব বিস্তার করেন। তিনি এটা উপলব্ধি করেছিলেন যে, পিটিশনের মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা লাভ করা যাবে না, বিপ্লবের মাধ্যমেই দেশের স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে। ইংল্যান্ডে থাকার সময় তিনি Lotus and Dagger নামক গুপ্ত সমিতির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন।
বরোদা কলেজের অধ্যক্ষ হয়ে
তিনি ভারতে আসেন। এই সময়ে তিনি মহারাষ্ট্রের বিপ্লবী সমিতির নেতা ঠাকুরসাহেবের (উদয়পুরের
এক অভিজাত পুরুষ) সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন।
তখনকার দিনে এই ঠাকুরসাহেবের উপরই ভারতের বৈপ্লবিক সংগঠন ও কার্যকলাপের দায়িত্ব ন্যস্ত
ছিল। ঠাকুরসাহেবের প্রেরণায় তিনি বোম্বাইয়ের এক বিপ্লবী সংগঠনে যোগ দেন। সেই সময় থেকে তাঁর মনে এই দৃঢ় প্রত্যয় জন্মাল
যে, বিপ্লবী সংগঠন গড়তে না পারলে বিপ্লব সংগঠিত করা যাবে না । তখনকার রাজনৈতিক অবস্থা
পর্যালোচনা করে তিনি এটাও উপলব্ধি করলেন যে, বিপ্লবী সংগঠন গড়ার উর্বর ক্ষেত্র হচ্ছে
বাংলাদেশ। এই সংগঠন গড়ার জন্য তিনি ১৯০২ সালে বাংলাদেশে এলেন। এই সময়ে বাংলাদেশে
ব্যারিস্টার পি মিত্র ‘অনুশীলন সমিতি’ গঠন করেন। বাংলাদেশে এসে অরবিন্দ অনুশীলন
সমিতির সংস্পর্শে আসেন। এই ১৯০২ সালেই তিনি হেম কাননগো ও সত্যেন বসকে বিপ্লবমন্ত্রে
দীক্ষিত করেন।
১৯০৩ থেকে ১৯০৫ সাল ছিল বাংলাদেশে
বিপ্লবের বাণী প্রচারের অধ্যায়। এই সময়েই প্রকাশিত হতে থাকে সন্ধ্যা, বন্দেমাতরম,
যুগান্তর প্রভৃতি পত্রিকা। সখারাম গণেশ দেউস্কর, পি মিত্র, যতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের
তত্ত্বাবধানে বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের নানা তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক দিক সম্পর্কে বিপ্লবী
যুবকদের শিক্ষাদান পর্ব চলে।১৯০৪ সালে অরবিন্দ ঘোষ আবার বাংলাদেশে আসেন। তখন তাঁর ভ্রাতা
বারীন ঘোষ অনুশীলন সমিতিতে যোগ দান করেন।
১৯০৫ সালে কার্জন সাহেবের
বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা সমগ্র বঙ্গদেশকেই আলোড়িত করে তোলে। বিক্ষুব্ধ বঙ্গবাসীরা বিদ্রোহের
ধ্বজা নিয়ে আন্দোলনের পথে অগ্রসর হয়। ১৯০৬ সালে অরবিন্দ স্থায়ীভাবে বাংলদেশে বসবাসের
জন্য আসেন এবং বঙ্গবাসীকে বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষিত করার অভিযান শুরু করে দেন। এই সময়ে
বারুইপুরে ও উত্তরপাড়ায় তাঁর জ্বালাময়ী ভাষণ ইতিহাস হয়ে রয়েছে। ভগিনী নিবেদিতাও
তখন। বিপ্লববাদী যুবকদের সাহায্য করতে থাকেন। এই সময়ে বিপ্লববাদীদের প্রচারের ধারার
নিদর্শন হিসাবে ১৯০৬ সালের একটি লেখার উল্লেখ করা যেতে পারে। বাংলার বিপ্লবীদের মুখপত্র
‘যুগান্তর’ ১৯০৬ সালে বরিশালে ব্রিটিশ শাসকদের নিষ্ঠুর দমনপীড়নের পর ২৬শে এপ্রিল সম্পাদকীয়তে
খোলা খুলি লিখলঃ
“দেশের ৩০ কোটি মানুষ যদি
তাদের ৬০ কোটি হাত প্রতিরোধের প্রতিজ্ঞায় তুলে ধরে তবেই বন্ধ হবে এ অত্যাচার। একমাত্র
শক্তি দিয়েই শক্তির প্রকাশকে স্তব্ধ করা সম্ভব।”
ব্রিটিশ শাসকদের অত্যাচারের
বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাবার জন্য বাংলার যুবকেরা তখন জেগে উঠেছে। যেখানেই ইংরেজের অত্যাচার
দেখছে সেখানেই তাঁরা প্রতিবাদ জানাচ্ছে। এই প্রতিবাদের জন্য তারা নির্যাতিত হতে থাকে।
এই নির্যাতনের প্রতিবাদে বাংলার দিকে দিকে বিক্ষোভ ধূমায়িত হয়ে ওঠে। এই বিক্ষোভকে
সংগঠিত রূপ দেবার জন্য অরবিন্দের বিপ্লবী মন্ত্রে দীক্ষিত যুবকরা সচেষ্ট হয়ে ওঠে।
ব্রিটিশ শাসকদের নির্যাতন যতই বাড়তে থাকল, বাংলাদেশে সশস্ত্র বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের
আকাঙ্ক্ষা ততই প্রবল হয়ে উঠতে লাগল । ঝামাপুকুর ও মানিকতলায় বোমা তৈরি করার কেন্দ্র
গড়ার প্রচেষ্টা চলল। বিপ্লবের এই গোপন আয়োজন ক্রমে ক্রমে মেদিনীপুর, চন্দননগর, কৃষ্ণনগর,
শ্রীহট্ট, বগুড়া, রংপুর, বরিশাল, ঢাকাতেও ছড়িয়ে পড়ল। অনশীলন সমিতির শক্তিশালী কেন্দ্র
গড়ে উঠলো ঢাকায়।
এ সময়ে একটা অদ্ভুত ঘটনা
ঘটল যে-ঘটনায় বিপ্লবী যুবকরা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল। তখন কলকাতার চীফ প্রেসিডেন্সী ম্যাজিস্ট্রেট
ছিল “কিংসফোর্ড”। এই কিংসফোর্ডের আদালতে ষোলো বছরের যুবক সুশীল সেনের মামলায়
আলোড়ন সৃষ্টি হলো। সুশীলের অপরাধ, সে এক উদ্ধত নিষ্ঠুর অশ্বারোহী ইংরেজ সার্জেন্টকে
জনতার উপর অত্যাচার করতে দেখে রুখে দাঁড়ায়। এ জন্য কিংসফোর্ড তাঁর বিচারে সুশীলকে
প্রকাশ্যে পনেরো ঘা বেত মারার অর্ডার দেয় এবং সেই অর্ডার কার্যকরী করতেও দেরি করা
হয় না। এই বিচারকে ‘অবিচার’ আখ্যা দিয়ে ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় কিংসফোর্ডের নাম দেন
‘কসাই কাজী’। তিনি তাঁর ‘সন্ধ্যা’ কাগজে এই ঘটনার উল্লেখ করে লিখলেনঃ “বালক সুশীলের
অঙ্গের এই বেত্রাঘাত যেন দেশবাসীর অঙ্গে আঘাত করিল।”
সত্যই তাই ঘটল। এই ঘটনায়
বাংলাদেশে যে আলোড়ন সৃষ্টি হলো তার অভিব্যক্তি দেখা গেল কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদের
গানে, যার প্রথম দুটি পংক্তি হলোঃ
“আমায় বেত মেরে কি মা ভুলাবি
আমি কি মা’র সেই ছেলে?”
শুধু এই অত্যাচার নয়, কিংসফোর্ড তখন জাতীয়তাবাদী সংবাদপত্রিকাগুলির কণ্ঠ রুদ্ধ করার অভিযান চালিয়েছিল। এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাবার জন্য অরবিন্দের নেতৃত্বে বিপ্লবীরা কিংসফোর্ডকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেন। এই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যাওয়ায় হেম কানুনগো ও বারীন ঘোষ কিংসফোর্ডকে হত্যা করার জন্য যে পরিকল্পনা করেন তাতে এ কাজ সুসম্পন্ন করার দায়িত্ব দেওয়া হয় দুই তরুণ ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকীর উপর । কিংসফোর্ড তখন মজফরপুরে। সেখানে ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকী কিংসফোর্ডকে হত্যা করতে গেলে লক্ষ্যভ্রষ্ট হন। প্রফুল্ল চাকী নিজের গুলিতে জীবন বিসর্জন দেন আর ক্ষুদিরামের হয় ফাঁসি। এ হচ্ছে ১৯০৮ সালের ঘটনা।
এই ঘটনার সূত্র ধরে পুলিস
আবিষ্কার করে মানিকতলায় বিপ্লবীদের বোমা বানাবার কারখানা। গ্রেপ্তার হলেন অরবিন্দ,
বারীন, উল্লাসকর, কানাইলাল, সত্যেন, নরেন গোঁসাই এবং আরও অনেকে। শুরু হয় মানিকতলা
বোমার মামলা (১৯০৮)। এই মামলায় নরেন গোঁসাই রাজসাক্ষী হয়। কানাইলাল দত্ত ও সত্যেন
বসু আলিপুর জেলের মধ্যেই রিভলভার স্মাগল করে নিয়ে গিয়ে হাসপাতালে গুলি করে নরেন গোঁসাইকে
খুন করে রাজসাক্ষীর পুরস্কার দিয়ে দেয়। এর জন্য কানাইলাল ও সত্যেনের ফাঁসি হয়। মানিকতলা
বোমার মামলায় অরবিন্দ অবশ্য মুক্তি পান। কিন্তু বারীন ঘোষ, উল্লাসকর প্রমখের যাবজ্জীবন
কারাদণ্ড হয় এবং তাদের আন্দামানের সেলুলার জেলে নির্বাসিত করা হয়।
মানিকতলা বোমার মামলার সঙ্গে
সঙ্গে শেষ হয় বিপ্লবীদের কার্যকলাপের একটা অধ্যায়। অরবিন্দেরও সশস্ত্র বিপ্লবের রাজনীতির
এখানেই সমাপ্তি। এ অধ্যায় শুধু বাংলাদেশের নয়, অন্যান্য প্রদেশেরও। এ সময়ে মহারাষ্ট্রে,
দক্ষিণ ভারতে এবং পাঞ্জাবেও বিপ্লবীদের কার্যকলাপ প্রসারিত হয়।
১৮৯৭ সানে পুনাতে দু’জন অত্যাচারী
ইংরেজ কর্মচারীকে – র্যান্ড ও আয়ার্স্টকে হত্যা করেন মারাঠী দুই ভাই দামোদর
ও বালকৃষ্ণ চাপেকর। এদের দুজনেরই ফাঁসি হয়। এদের আর এক ভাই বাসুদেওরও ফাঁসি হয় ঐ
একই মামলায়। পরবর্তীকালে মহারাষ্ট্রের আরও তিনজন তরুণ দেশপ্রেমিক অনন্তলক্ষণ কানহেরে,
কৃষ্ণগোপাল কার্ভে আর বি নায়ক নারায়ণ দেশপাণ্ডে ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে জীবনের জয়গান
গেয়ে গেলেন। তারিখটা ছিল ১৯১০ সালের ১০ই এপ্রিল। ১৯০৯ সালের ২১শে ডিসেম্বর নাসিকের
অত্যাচারী কালেক্টর জ্যাকসনকে হত্যা করার অভিযোগে এদের ফাঁসির হুকুম হয় ১৯১০
সালের ২৯শে মার্চ।
মহারাষ্ট্রে নাসিকের বিপ্লবী
গণেশ দামোদর সাভারকর ও তাঁর ভাই বিনায়ক দামোদর সাভারকর ১৮৯৯ সালে “মিত্রমেলা’
ও ১৯০৭ সালে ‘অভিনব ভারত সমিতি’ নামে বিপ্লবী সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। বিনায়ক
১৯০৬ সালে লন্ডনে গিয়ে কৃষ্ণবর্মা প্রতিষ্ঠিত ইন্ডিয়া হাউসের তত্ত্বাবধান এবং তরুণ
প্রবাসী বিপ্লবীদের নিয়ে ‘অভিনব ভারত সমিতি’ গড়ার কাজে বিশেষ উদ্যোগী হন।
তাঁরই অনুগামী মদনলাল ঢিংড়া নামে এক ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্র ১৯০৯ সালের ১লা জুলাই লন্ডনে
জাহাঙ্গীর হলে অনুষ্ঠিত এক পাটিতে স্যার জন কার্জন-ওয়াইলি নামে এক বিশিষ্ট রাজপুরুষকে
গুলি করে হত্যা করেন। ১৯০৯ সালের ১৭ই আগস্ট তাঁর ফাঁসি হয় লন্ডনের জেলে। বীরের মৃত্যুবরণ
করে নিয়ে ঢিংড়া তাঁর অন্তিম বিবৃতিতে লেখেনঃ
“বিদেশী সঙ্গীনের সাহায্যে
যে জাতিকে দাবিয়ে রাখা হয় তার তো নিরন্তর সংগ্রাম চালু থাকে অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে।
ভারতে এখন একমাত্র যে শিক্ষার প্রয়োজন তা হলো চরম আত্মদানের শিক্ষা, যে শিক্ষা অন্যকে
দেওয়া যায় নিজে প্রাণদান করে, সুতরাং আমি আত্মদান করছি এবং গৌরব বোধ করছি এই শহীদ
বরণে।“
ঢিংড়ার কাজকে সমর্থন করে তখন দৃপ্ত সম্পাদকীয় লিখলেন পারিসের সংবাদপত্র ‘তলোয়ার’-এ প্রসিদ্ধ পার্শী মহিলা বিপ্লবী ভিখাজি রুস্তম কামা। ‘মাদাম কামা’ নামে সুপরিচিতা এই প্রবাসী ভারতীয় বিপ্লবীর কর্মক্ষেত্র ছিল প্রথমে লন্ডন ও পরে প্যারিসে। সেখানে তিনি ও সর্দার সিং রাওজী রানা নামে আর এক বিপ্লবী দেশে অস্ত্র পাঠানো, বিপ্লবীদের অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহারে ট্রেনিং দেওয়ার ব্যবস্থা করা ইত্যাদি কাজে নিযুক্ত ছিলেন। ১৯০৭-এ স্টুটগার্টে আন্তর্জাতিক সমাজতন্ত্রী কংগ্রেসে যোগ দিয়ে তিনি পেশ করলেন ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি – বিশ্বের দরবারে এই প্রথম।
বিপ্লবী আন্দোলন বিস্তৃত হলো
দক্ষিণ ভারতেও। পূর্ণ স্বাধীনতাই ভারতের লক্ষ্য, এ কথা ঘোষণা করেন চিদাম্বরম পিল্লাই।
তাঁর গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে জঙ্গী ধর্মঘট হলো টিনেভেলিতে। ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট অ্যাশ
নির্দেশ দিলেন গুলি চালাবার। প্রাণ হারালেন অনেকে। বিপ্লবী ওয়াঞ্চি আয়ার প্রতিশোধ
নিলে অ্যাশকে হত্যা করে। তারপর আত্মহত্যা করলেন গ্রেপ্তার এড়াবার জন্য।
লক্ষ্য করবার বিষয়, বাংলাদেশের
বিপ্লবীদের কার্যকলাপে অনুপ্রাণিত হয়ে দক্ষিণ ভারতের তরুণেরা বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে উঠলেন।
গঠিত হলো গুপ্ত সমতি । সশস্ত্র বিপ্লবের জন্য পণ্ডিচেরী হয়ে উঠলো তাদের শিক্ষাকেন্দ্র।
দাক্ষিণাত্যে তখন জাতীয়তাব ইতিহাসে আবির্ভূত হতে লাগলেন বিভিন্ন নেতা। সুব্রহ্মণ্যম
ভারতী, চিদাম্বম পিল্লাই সুব্রহ্মণ্যম শিব,
নীলকণ্ঠ ব্রহ্মচারী, হরিহর শর্মা প্রমুখ প্রতিভাবান ব্যক্তি। ১৯১১ সালের “তিরুনেলভেলি
ষড়যন্ত্র মামলা”য় অভিযুক্ত হলেন নীলকণ্ঠ ব্রহ্মচারী এবং আরও অনেকে। দীর্ঘ কারাদণ্ডে
তাঁরা দণ্ডিত হন। নীলকণ্ঠ ব্রহ্মচারী ধরা পড়েছিলেন কলকাতায়।
বিপ্লবী আন্দোলনের ক্ষেত্রে
মহারাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মতো গৌরবময় স্থান
ছিল পাঞ্জাবের। তখন বিশেষ করে শিখদের মধ্যেই বিপ্লবী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল। এদের
সঙ্গে বাংলায় বিপ্লবীদের যোগাযোগ রক্ষা করতেন
রাসবিহারী বসু। পাঞ্জাবের বিপ্লবীরা ১৯১২ সালের ১২ ডিসেম্বর দিল্লিতে বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জের
উপর বোমা নিক্ষেপ করেন। বড়লাট গুরুতর আহত হয়। কিন্তু প্রাণে বেঁচে যায়। এই ঘটনাকে
কেন্দ্র করে ব্রিটিশ শাসকেরা শুরু করে দিল্লি ষড়যন্ত্র মামলা। সেই মামলায়
চারজন বিপ্লবীর ফাঁসি হয় ১৯১৩ সালে। এরা হলেন : (১) মাস্টার আমীর চাঁদ, (২) অবোধবিহারী,
(৩) বালমুকুন্দ। (৪) বসন্ত বিশ্বাস। পাঞ্জাবের এই বিপ্লবীদের পিছনে ছিলেন রাসবিহারী
বসু। তিনি তখন আত্মগোপন করেন ভবিষ্যৎ কর্মপন্থার জন্য।
প্রথম মহাযুদ্ধ (১৯১৪) শুরু
হবার সঙ্গে সঙ্গে বিপ্লবীরা সশস্ত্র বিদ্রোহের জন্য তৎপর হয়ে ওঠেন।
(চলবে)
0 Comments