ভারতে বিজ্ঞান চর্চার পথিকৃৎ: ডা.মহেন্দ্রলাল সরকার (Dr Mahendralal Sarkar)


২৭অক্টোবর ১৮৩৩। খবর এল বিলেতের ব্রিস্টল শহরে প্রয়াত হয়েছেন রাজা রামমোহন রায়।আর তার মাত্র পাঁচদিন পর ১৮৩৩ সালে ২নভেম্বর হাওড়া জেলার পাইকপাড়া গ্রামে জন্ম হল মহেন্দ্রলাল সরকারের।ভারতবর্ষের জাতীয় বিজ্ঞান শিক্ষা ও গবেষণার পথিকৃৎ ছিলেন এই মহেন্দ্রলাল। মাত্র ন'বছর বয়সে পিতা মাতাকে হারিয়ে কলকাতায় মামার বাড়িতে চলে যান।১৮৪৯ সালে হেয়ার স্কুল থেকে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে পাশ করলেন। পেলেন উচ্চ শিক্ষার জন্য বৃত্তি। ভর্তি হলেন হিন্দু কলেজে। হিন্দু কলেজের শিক্ষা শেষ করে প্রবেশ করলেন কলকাতা মেডিকেল কলেজে। ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে সেখান থেকে এম ডি ডিগ্রি লাভ করে চিকিৎসা ব্যবসা শুরু করেন।
জীবনের প্রথম ত্রিশ বছর তাঁর চরিত্রের যে প্রধান দিক গুলি অঙ্কুরিত হয়েছিল তাই পরবর্তী কালে তাঁকে বিশিষ্ট করেছিল। শৈশব ও কৈশরের দারিদ্র্য ও অসহায়তা তাঁকে একরোখা, পরিশ্রমী করেছিল আর প্রথম যৌবনে ইংরেজ শিক্ষাবিদদের অধীনে চিকিৎসা শিক্ষা গ্রহণ করে তিনি হয়েছিলেন প্রথম শ্রেণির যুক্তিবাদী।
ষাটের দশকের গোড়ায় যখন মহেন্দ্রলাল পাশ করে ডাক্তারি আরম্ভ করলেন তখন কোম্পানির শাসন এর অবসান ঘটেছে। কলকাতা সহ তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে। ব্রিটিশ  ইতিহাস, দর্শন, বিজ্ঞান , রাজনীতি ভারতীয়দের মনে তখনও স্থান পায়নি। বরং শিক্ষিত ভারতবাসী বা জমিদাররা সিপাহী বিদ্রোহ পরবর্তী উত্তর ভারতে নিপীড়ন, নীল চাষীদের ওপর অত্যাচার কিছুটা আলোড়ন তুলেছিল। বিশেষ করে হরিশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত 'হিন্দু প্যাট্রিয়ট' পত্রিকা ব্রিটিশ শাসনের নগ্ন রূপ প্রকাশ করেছিল।
 এর সঙ্গে এই সময় মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের হতাশা , অভিমান ও খেদ জন্মাচ্ছিল। ইউরোপের শিক্ষা সাহিত্য সংস্কৃতি আত্মস্থ করে এই শ্রেণি নিজেদের অধিকারকে বুঝে নিতে চাইছিল।কিন্তু ইংরেজ রা কিছুতেই সে সুযোগ দিতে প্রস্তুত ছিলনা।শতাব্দীর মধ্যভাগে যখন প্রথম টেলিগ্রাফ লাইন বসে, সে কাজের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন শিব চন্দ্র নন্দী।কিন্তু তাঁর পদমর্যাদা ও বেতন ছিল ইউরোপীয় দের তুলনায় অনেক কম। রাধনাথ শিকদার সু উচ্চ শৃঙ্গ গুলির উচ্চতা মাপলেও কৃতিত্বের অংশীদার হয় উচ্চ পদস্থ ইংরেজরা।রসায়নবিদ অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায় জার্মানি থেকে বিজ্ঞান শিখে এসে বহু চেষ্টা করেও উপযুক্ত কাজ পেলেন না। আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বেশিদিন গণিত চর্চা করলেন না, তিনি আইন পড়ে চলে গেলেন হাই কোর্টে। শুধু চাকরি বা পেশাগত ক্ষেত্রে যে বঞ্চনা চলছিল তা নয়, অন্যত্রও অবস্থা ছিল অনুরূপ।শিক্ষিত ভারতীয়রা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারছিলেন না।
মহেন্দ্রলাল ১৮৬৭ সাল থেকে একটি জাতীয় বিজ্ঞান সঙ্ঘ গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রচার চালাচ্ছিলেন। তিনি স্বপ্ন দেখতেন, তাঁর ভাবনায় মূর্ত হয়ে উঠত একটি বিজ্ঞায়তনের পরিকল্পনা, যার অর্থ আসবে নেটিভ ভারতীয়দের কাছ থেকে , যেটি পরিচালিত হবে ভারতীয়দের দ্বারা, যার লক্ষ্য হবে জাতীয় পুনর্গঠনের লক্ষ্যে ভারতীয় বিজ্ঞানীদের একটি সমন্বিত অবস্থান। এই ভাবনা থেকেই ১৮৭৬ সালে গড়ে উঠল The Indian Association for the Cultivation of Science (IACS) মহেন্দ্রলাল হলেন তার প্রথম সম্পাদক।
সরকার শেষ পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক ও প্রশাসনিক সহায়তা দানের কথা ঘোষণা করলেন। মহেন্দ্রলাল চেয়েছিলেন তাঁর দেশ বাসীর অর্থানুকূল্যে এই প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠুক, যাতে এটি প্রকৃত অর্থে জাতীয় প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠতে পারে। তিনি এদেশীয় রাজা, জমিদার ও বিত্তশালী মানুষের কাছে অর্থের আবেদন জানালেন।নিজের গচ্ছিত অর্থ সবটাই দান করলেন।তাঁর এই আহবানে তিনি বিপুল সাড়া পেলেন।যাঁরা সাহায্যের অকৃপণ হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন -জয় কৃষ্ণ মুখার্জী,,রাজা কমল কৃষ্ণ দেব,দিগম্বর মিত্র, যোগেশ্বর সিং, পন্ডিত ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর,মহারাজা যতীন্দ্র মোহন ঠাকুর, দ্বারকা নাথ মিত্র, মহারানী স্বর্ণময়ী দেবী, প্রমুখ। এভাবে ভারতীয় দের দানে গড়ে উঠল মহেন্দ্রলালএর স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান- IACS.
IACS  এর প্ৰতিষ্ঠা ব্যর্থ হয়নি। এর প্রভাবেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানের বিষয় গুলিতে সাম্মানিক ও স্নাতকোত্তর পাঠের সূচনা হয়। স্যার সি ভি  রমন ও কে এস কৃষনানের মত বিজ্ঞানী এই প্রতিষ্ঠানেই তৈরি হন। National Council of Education মহেন্দ্রলালএর সূত্র ধরেই College of Science এবং Technical Education পত্তন করে। বিজ্ঞান ব্যবহার করে দেশীয় শিল্প গড়ে তোলার তাঁর প্রাথমিক কাজ গুলি থেকে স্বদেশী শিল্প সংস্থাগুলি গড়ে ওঠে।
Indian Association for the Cultivation of Science ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার নবজাগরণের এক গুরুত্বপূর্ণ অবদান। ভারতীয়দের দানে এবং সম্পূর্ন ভারতীয়দের উদ্যোগে ও পরিচালনায় IACS প্রতিষ্ঠার আগে এবং পরে একই ধরনের বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান তৈরী হলেও কোনওটাই সেভাবে বিকাশ লাভ করল না। শুধু তাই নয়, এটার সূত্রপাত হয়েছিল স্বদেশী উদ্যোগে এবং একমাত্র ভারতীয়দের দানে এই প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল। এক কথায় এটা ছিল তারই মস্তিস্ক প্রসূত , যিনি ছিলেন জাতীয় বিজ্ঞানের প্রধান উদ্যোগী। এপ্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং ইউরোপিয়ান মিশনারীরা আধুনিক বিজ্ঞান চর্চার জন্য বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান এবং গবেষণাগার তৈরি করলেও, তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থে কিছু জোগাড়ের সৃষ্টি করা। কিন্তু IACS একমাত্র প্রতিষ্ঠান যেখানে এদেশের সন্তানেরাই বিজ্ঞানের মৌলিক গবেষণায় নিয়োজিত থাকবেন এবং স্বদেশের সমৃদ্ধি ও স্বনির্ভরতা স্বার্থে গবেষণার ধারা নির্ধারিত করবেন।
সবচেয়ে দুঃখের কথা এই যে ১৮৬ বছর আগে যিনি ভবিষ্যৎ ভারতবর্ষের বিজ্ঞানের উন্নতি সম্বন্ধে এভাবে ভেবেছিলেন ও নিঃস্বার্থ ভাবে কাজ করে গিয়েছেন সেই মহেন্দ্রলাল সরকারকে আমরা প্রায় ভুলতে বসেছি।আরও দুঃখের কথা , যে সায়েন্স এসোসিয়েশন দেশে বৈজ্ঞানিক গবেষণার পথিকৃৎ, জাতীয় গবেষণাগারের মর্যাদা ও স্বীকৃতি এখনো তার ভাগ্যে জুটল না। 

ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার আমাদের দেশে বিজ্ঞান চেতনা নির্মাণের অন্যতম কারিগর হিসাবে চিরদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবেন, যিনি একটি পিছিয়ে পড়া প্রাচীন সমাজকে বিজ্ঞান চেতনার আলোকে আলোকিত করেছিলেন।

Post a Comment

0 Comments