পাথর চাপুড়ির দাতাবাবার মেলা Patharchapuri Datababa Mela


বীরভূম জেলার সিউরি থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে পাথর চাপুড়ি গ্রাম। এই পাথর চাপুড়ি গ্রামে দাতাবাবা নামে পীরের মাজারে প্রতি বছর ৯ থেকে ১৫ চৈত্র যে বিশাল মেলা বসে তা দাতাবাবার মেলা নামে পরিচিত। বহু দূর দুরান্ত থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ আসেন এই মেলাতে। পশ্চিম বঙ্গ ছাড়াও বিহার, উত্তর প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, অন্ধ্র, রাজস্থান, দিল্লী, এমনকি বাংলাদেশ সহ প্রতিবেশী দেশ গুলি থেকেও সমস্ত ধর্মের  প্রচুর দর্শনার্থী আসেন এই মেলায়। 
হজরত দাতা মেহেবুব শাহ ছিলেন একজন নামকরা সুফি পীর। যদিও প্রচার বিমুখ এই সাধকের প্রকৃত পরিচয় , নাম, ধর্ম ইত্যাদি আজও অজানা। অনেকে মনে করেন তিনি ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পলাতক সেনানি। কথিত আছে  বাল্যকালে পারস্য দেশের গল্প শুনতে শুনতে সেই দেশের প্রতি আকৃষ্ট হন। হজরত দাতা মাহবুব শাহ যিনি  পরবর্তী কালে দতাবাবা নামে পরিচিত হন। তিনি  ইরানে গিয়ে সেখানকার দরবেশের কাছে উপদেশ ও জ্ঞান সঞ্চয় করে যখন দেশে ফিরে আসেন তখন তাঁর গলায় যজ্ঞের উপবীত , হাতে দরবেশ প্রদত্ত মালা এবং শরীরে হিন্দু ও মুসলমানের আভূষণ। নানান জায়গা ঘোরার পর তাঁর অলৌকিক কাজ কর্মের প্রকাশ পায় যখন তিনি পাথর চাপুড়ি গ্রামে আসেন। পাথর চাপুড়ি গ্রামের মানুষ তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে কুঁড়ে ঘরের ব্যবস্থা করে দেয়। সময়ের সাথে দাতাবাবার সাহায্য এবং অলৌকিক ক্ষমতার কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।  শোনা যায় তিনি গড়গড়ার (তামাক সেবনের এক প্রকার যন্ত্র) ছাই থেকে বিভিন্ন রোগীর রোগ সারিয়েছেন। তাঁর একজন প্রধান ভক্ত ছিলেন পাথর চাপুরি গ্রামের পাশে পাতাডাঙ্গা গ্রামের বিমলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। হিন্দু মুসলিম সকলের কাছেই পীর দাতা মেহেবুব শাহ একজন মরমিয়া ফকির সাধক হিসেবে শ্রদ্ধেয়। 

দাতাবাবা ছিলেন সদা হাস্যময়, দীর্ঘ দাড়ি, আজানুলম্বিত বাহু, হলুদবরণ কৃশকায় শরীর, তেজদীপ্ত মুখমণ্ডল, গলায় যজ্ঞোপবীত এবং হাতে চিমটা ও লাঠি। ধর্মাধর্ম, জাতপাত, ভেদ বিভেদ তিনি মানতেন না। নিজে সর্বত্যাগী হলেও নিরন্নকে দিতেন অন্ন, শীতার্তকে পোশাক, নিরাশ্রয় কে আশ্রয়, অসুস্থকে প্রয়োজনীয় ওষুধ ও সেবা। আজও বিশ্বাস, নিষ্ঠা, ভালবাসা, থেকে যারা দাতাবাবার মাজারে আসেন তাদের আশা পূর্ণ হয়।



১২৯৮ সালের চৈত্র সন্ধ্যে বেলা দাতাবাবা দেহরক্ষা করেন।তাঁর প্রয়াণের দিনটিকে স্মরণ করে ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে তদানীন্তন জেলা শাসক তথা ব্রতচারি খ্যত গুরুসদয় দত্ত সরকারিভাবে এখানে প্রথম মেলার উদ্বোধন করেন। তারপর থেকে  মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষ্যে দাতাবাবার মাজার ঘিরে উরস উৎসব পালিত হয়। এই উরস উৎসব বিশাল আকার ধারণ করে শালের সুদীর্ঘ তরুশাখা, বিরাট বিরাট মহুয়া গাছ আর নানা প্রকার বনফুলের মাঝে দাতাবাবার সমাধি। সমাধির ভিতর নানা বর্ণের মার্বেল পাথর। সমাধির পাশে দাতাবাবার চিমটে ও লাঠি, যা বহু অলৌকিক ঘটনার সাক্ষী। প্রতি বৎসর ৯ থেকে ১৫ চৈত্র দাতাবাবার সমাধি ঘিরে চলে মেলা। লক্ষ লক্ষ দর্শনার্থী আসেন এই মেলায়। দাতাবাবার লঙ্গরখানায় থাকে কয়েক লক্ষ লোকের খাবার ব্যবস্থা। মুসলমান দের জন্য পলান্ন আর হিন্দুদের জন্য মিস্টি ও সিন্নি। দিবারাত্র চলে মন্ত্রপাঠ । সন্ন্যাসী, ফকির দরবেশ- সকলকে দাতাবাবার চাদর দিয়ে পরের বৎসর আসার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। বহু মানুষের সমাগমে মেলা প্রাঙ্গণ হয়ে ওঠে জনসমুদ্র। 
মেলার সময় প্রয়োজনের তুলনায় ঘর থাকে অতি সামান্য। দিনে রাতে খোলা আকাশের নীচে শিশু সন্তান সহ বহিরাগতরা নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকেন। এই সময় থাকেনা মশা, মাছি, সাপ, বিছে,কুকুরের আনাগোনা, চোর ছ্যাঁচড়ের উপদ্রব বা সংক্রামক ব্যধি সংক্রমণ। প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ কানা খোঁড়া, ফকির, দরবেশ, আউল, বাউল, সাধু, সন্ন্যাসী, ও সাধারণ মানুষের অসাধারণ সহাবস্থান দেখা যায়। 

সম্প্রতি এই মেলায় যে লক্ষ লক্ষ মানুষজন আসেন তাদের দান সামগ্রীর দ্বারা এই স্থানে একটি মসজিদ এবং একটি উচ্চবিদ্যালয় ( আল আমিন মিশন)  স্থাপিত হয়েছে।



Post a Comment

0 Comments