বিদ্যাসাগরের জীবন- নতুনভাবে ফিরে দেখা

 বিদ্যাসাগরের জীবন- নতুনভাবে ফিরে দেখা

Vidyasagar



বিদ্যাসাগরকে আমারা মুলত জানি একজন বিখ্যাত সমাজ সংস্কারক ও শিক্ষা সংস্কারক রূপে। তাঁর দানশীলতার জন্য দয়ার সাগরের ও কিছু পরিচয় আমরা জানি। কিন্তু তাঁর জীবনের যে বিষয়গুলি নিয়ে সেরকম চর্চা হয়নি বললেই চলে তা হল তাঁর বিজ্ঞান মনস্কতা। বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসারে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদানের কথা।শিশু মনোবিজ্ঞান ও পরিবেশ বিজ্ঞানের প্রসারে তাঁর অবদানের কথা, দক্ষ শিক্ষা প্রশাসক হিসেবে তাঁর ভুমিকার কথা।

বিজ্ঞানসম্মত শিশুপাঠ্য

বিদ্যাসাগর ছিলেন একজন যথার্থ শিশু মনোবিজ্ঞানী। তাঁর শিক্ষা ভাবনার যে গুরুত্বপূর্ণ দিক গুলি আমরা দেখতে পাই তার প্রথমেই আসে শিশু শিক্ষা বা প্রাথমিক শিক্ষা ।তার আগে যে কেউ শিশু শিক্ষার বিষয়ে কিছু ভাবেনি এমন নয়, যেমন তার পরম বন্ধু মদনমোহন তর্কালঙ্কার লিখেছিলেনশিশু শিক্ষা” নামক গ্রন্থ।  অত্যন্ত জনপ্রিয় শিশু পাঠ্যপুস্তক ছন্দ ছড়ায় প্রকাশিত হলেও বিদ্যাসাগর স্বয়ং ১৮৫৫ সালে বর্ণপরিচয় রচনা করেছিলেন শুধুমাত্র প্রচলিত শিশুপাঠ্য এর সীমাবদ্ধতা অনুভব করে। কি সেই সীমাবদ্ধতা? বাংলা ভাষাভাষীদের পক্ষে সহজ অভ্যস্ত উচ্চারণের মর্যাদা দেওয়ার জন্য এর আগে কেউ যা করেনি বিদ্যাসাগর তাই করলেন সংস্কৃত অনুসারী প্রচলিত বর্ণমালার সংস্কার করলেন সংস্কৃত ভাষা অনুসারী ১৬ টি স্বরবর্ণ এবং 34 টি ব্যঞ্জনবর্ণ থেকে প্রয়োজনবোধে বেছে নিলেন প্রথমে বারোটি স্বরবর্ণ।  স্বরবর্ণের  দীর্ঘ এবং দীর্ঘ ৯ত্যাগ করলেন কারণ বাংলাতে এদের পৃথক উচ্চারণের স্থান নেই। অনুস্বার ও বিসর্গকে স্থান দিলেন স্বর বর্ণের পরিবর্তে ব্যঞ্জনবর্ণ। অন্যদিকে ব্যঞ্জনবর্ণে 34 টি বর্ণ ছাড়াও আরও 6 টি বর্ণ যুক্ত করলেন। সংস্কৃত বর্ণমালায় ড় ও ঢ় এর ব্যবহার হয় না অথচ এদের উচ্চারণ ড বা ঢ থেকে আলাদা।  উচ্চারণের সুবিধার জন্য এদের তিনি ব্যঞ্জনবর্ণের স্থান দিলেন। একইভাবে স্থান দিলেন য় কে। অনুস্বার ও বিসর্গ ছাড়াও চন্দ্রবিন্দুকেও  স্থান দিলেন ব্যঞ্জনবর্ণ।  আদিতে ক্ষ এর অবস্থান ছিল ব্যঞ্জনবর্ণ, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি সংযুক্ত বর্ণ।  এইভাবে পূর্বসূরীদের অনুসরণ না করে দেবনাগরী লিপি দাসত্ব থেকে মুক্তি দিয়ে বিদ্যাসাগর বাংলা বর্ণমালার সংস্কার করলেন একেবারে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে। বর্ণের সঙ্গে প্রাথমিক পরিচিতির পর  শেখালেন ছোট ছোট শব্দ বন্ধ। তারপর ছোট ছোট গদ্যের ব্যবহার। ক্রমশ ছোট ছোট সরল বাক্য। যুক্ত বর্ণের ব্যবহার এবং সেগুলি দিয়ে বাক্য গঠন। এভাবেই শিক্ষার্থীকে সংস্কৃত ভাষার দুরূহ জগত থেকে মুক্তি দিলেন ।তিনি জানতেন শিশুরা ছোট ছোট বাক্য বলে, মনে রাখে ছোট ছোট বাক্য, একইসঙ্গে গল্পের মেজাজে সহজ গদ্যের ব্যবহারে শিশু শিক্ষার্থীর প্রাথমিক মনোযোগ আদায় করলেন। এভাবেই নির্মিত হলো বিজ্ঞানসম্মত প্রাথমিক শিশুপাঠ্য যা আজও প্রাসঙ্গিক।

বিজ্ঞান মনস্কতায় জীবনচরিত

  শিশুরা গল্প শুনতে ভালোবাসে, সে কথা মাথায় রেখে অক্ষর পরিচয় এর পরে  তাদের বয়সের উপযোগী পাঠ্যপুস্তক নিজেই রচনা করেন। আর এই পাঠ্যপুস্তক এর উপাদানে অকাতর ভাবে ছড়িয়ে দিয়েছেন বিজ্ঞানমনস্কতা, যাতে পরিণত জীবনে কুসংস্কার মুক্ত যুক্তিনিষ্ঠ মন গড়ে ওঠে। সমকালীন শিক্ষাব্যবস্থায়, বিদ্যালয় স্তরে বিজ্ঞান শেখানোর বিষয়টি ছিল একান্তভাবেই স্বপ্নের অতীত। সেই সময়ে ছাত্রদের বিজ্ঞানচেতনা জাগানোর উদ্দেশ্যে লিখলেন দুটি বিশেষ বই, প্রথমটির নাম জীবনচরিত” বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের জীবনী পাঠের মাধ্যমে ছাত্রদের যাতে বিজ্ঞান- মনস্কো করা যেতে পারে, বাছাইপর্বে স্থান দিলেন তাদেরই যারা পৃথিবীতে বৈজ্ঞানিক অথবা বিজ্ঞান লেখক। যেমন জ্যোতির্বিদ নিকোলাস, কোপার্নিকা্সদূরবীক্ষণ এর আবিষ্কর্তা গ্যালিলিও, পদার্থবিদ আইজ্যাক নিউট্ন, উদ্ভিদ বিজ্ঞানী কার্ল লিনিয়াস প্রমুখ দের।

বিজ্ঞানের ধারাপাত- বোধোদয়

 দ্বিতীয় বই যাকে আমরা বলতে পারি বিজ্ঞানের ধারাপাত, সেই বোধোদয়” প্রকাশিত হয় ১৮৫১ সালের এপ্রিলে।বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষাবিদ বিদ্যাসাগর যথার্থই ভেবেছেন জীবনের প্রথম পর্বেই পরিবেশের বিভিন্ন উপাদান অর্থাৎ জড় জীব সম্বন্ধে শিক্ষার্থীদের ধারণা করা দরকার।

 

পরিবেশ সচেতনতায় কথামালা

আমরা আজ যাকে পরিবেশবিদ্যা বলে থাকি, যার উপাদানে রয়েছে মানুষ, উদ্ভিদ, প্রাণী বিভিন্ন অচেতন বস্তু এবং প্রত্যেকে প্রত্যেকের পারস্পরিক সম্পর্ক, এইসব নিয়ে গ্রীস দেশের পন্ডিত ঈশপের নীতি গল্পের অনুবাদ হয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায়। বিদ্যাসাগর ইংরেজি অনুবাদ থেকে বাংলা রূপান্তর করে সংকলনের নাম দিলেন কথামালা” প্রথমে ৬৮ টি গল্প এবং পরে আরও ছটিগল্প যুক্ত করলেন।  এভাবেই শিশুরা ক্রমাগত পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন হয়েছে

নৃতত্ত্বের প্রাথমিক ধারণা- আখ্যান মঞ্জরী

বিদ্যাসাগরের আরেকটি উপদেশ মূলক অনুবাদ গ্রন্থ আখ্যান মঞ্জরী”  মাধ্যমে তিনি নৃতত্ত্বের প্রাথমিক ধারণা দিয়েছেন। বিদ্যাসাগরের অক্লান্ত চেষ্টায় সেদিনের বাংলার কিশোর মনে সারা পৃথিবী যেন চোখের নাগালে ধরা দিয়েছিল

বিজ্ঞানের পরিভাষা নির্মাণ

বাংলায় গত শতকে, বাংলায় বিজ্ঞান চর্চার জন্য বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু উদ্যোগ নিয়েছিলেন,  তখন পরিভাষার সমস্যার কথা অনেকেই বলেছেন।  অথচ উনিশ শতকে বিদ্যাসাগর একক প্রচেষ্টায় সেই কাজ শুরু করেছিলেন।  বিদেশি বিজ্ঞানীদের জীবনী এবং সাহিত্যিকদের লেখা অনুবাদ করতে গিয়ে স্পষ্ট অনুভব করেছিলেন বাংলায় ইংরেজি অনুবাদ করা অত্যন্ত দুরূহ।  ইউরোপীয় ভাষা বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিদ্যা সংক্রান্ত আলোচনায় যথাযথ বাংলা শব্দ পাননি,  আর কারণেই সংস্কৃত শব্দের প্রয়োগ অনিবার্য হয়ে উঠেছে,  এভাবেই তিনি 74 টি ইংরেজি শব্দের বাংলা পরিভাষা তৈরি করেছেন।  বিদ্যাসাগরের সৃষ্ট অনেক পরিভাষা আমাদের চেনা।  বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা করেন,  তারা জানেন,  আজও বিদ্যাসাগরের এই পরিভাষা নির্মাণ কতটা প্রাসঙ্গিক।  ইংরেজির সায়েন্স শব্দটির বাংলা অনুবাদ যে বিজ্ঞান,  সে কথা তিনিই প্রথম জানালেন।  জ্যোতির্বিদ্যা, জ্যোতিষ্্দূরবীক্ষণ, বিষুব রেখা, পদার্থবিদ্যা, ইত্যাদি ব্যবহার তার হাত ধরেই।

বিজ্ঞান শিক্ষার গ্রন্থ রচনা

১৮৫৫ সালের তৎকালীন ডিপিআই গরডন ইয়ং কে চিঠিতে বিদ্যাসাগর লিখেছিলেন,  বিদ্যালয় স্তরে শিক্ষার জন্য কয়েকটি বিষয়ে অবিলম্বে নতুন বই লেখা দরকার।  কি নিয়ে লেখা হবে? প্রকৃতির প্রাথমিক পরিচয়,  ভারতের ভূতত্ত্ব,  গ্রীস,রোম, ইংল্যান্ড ভারতের ইতিহা্স‌, বিশিষ্ট ব্যক্তিদের জীবনী, ঈশপের গল্প থেকে শুরু করে পাটিগণি্,  প্রাকৃতিক দর্শন অর্থাৎ পদার্থবিদ্যা রসায়ন ইত্যাদির আদি কথা, শারীর বিদ্যা এবং জ্যোতির্বিদ্যার জনপ্রিয় রচনা নিয়ে বই লিখতে হবে।  

আরও পড়ুন- বীরসিংহ গ্রাম- বিদ্যাসাগরের জন্মস্থান 👈

দক্ষ শিক্ষা প্রসাসক

একজন দক্ষ প্রশাসক হিসেবে বিদ্যাসাগর দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।  সংস্কৃত কলেজের  অধ্যক্ষ হওয়ার পর তিনি দেখলেন কলেজে নেই কোন ক্লাস-রুটিন, হাজিরার নির্দিষ্ট সময়।  ছাত্ররা যখন খুশি আসে যায়, অধ্যাপকেরাও।  বিদ্যাসাগর চালু করলেন ক্লাস রুটিন, সকাল সাড়ে 10 টা থেকে বিকেল সাড়ে চারটে মাঝে  1 ঘন্টা একটা থেকে দুটো খেলার ছুটি।  সাড়ে দশটা বাজলেই অধ্যক্ষ বিদ্যাসাগর প্রত্যেক ক্লাসরুমে শিক্ষক এর উপস্থিতি নিজে পরীক্ষা করতেন আবার একইভাবে পরিদর্শন করতেন খেলার ছুটির পর।  সেসময় কলেজ বন্ধ থাকতো তিথি নক্ষত্র মেনে।  অষ্টমী ও প্রতিপদে ক্লাস ছুটি থাকত।  তিনিই প্রথম কাউন্সিল অফ এডুকেশন এর সেক্রেটারি কে চিঠি লিখে রবিবারের সাপ্তাহিক ছুটির অনুমোদন নিলেন।  চালু করলেন গ্রীষ্মাবকাশের ছুটি।কলেজের ছাত্র ভর্তির ক্ষেত্রে কাউন্সিল অফ এডুকেশন এর কাছে চিঠি লিখে অনুমোদন আদায় করলেন, কলেজে শুধু ব্রাহ্মন আর বৈদ ছাত্ররা নয়, কায়স্থ ছাত্ররাও পড়ার সুযোগ পাবেএবং পাঠান্তে যোগ্যতা অনুযায়ী হিন্দু কলেজ আর মাদ্রাসাছাত্রদের মত চাকরি পাবে

উনিশ শতকে শিক্ষা ব্যবস্থায় বিদ্যাসাগরের অবদানের উল্লেখ করতে হলে আরো বিস্তৃত পরিসরে চায় তার জীবনকে সঠিক ভাবে উপলব্ধি করা। তার মতো আদ্যান্ত সমাজসেবী শিক্ষা সংস্কারকের মানসিকতা বুঝতে সিউডো- ইন্টেলেকচুয়াল অথবা প্রচার সর্বস্ব  শিক্ষাতাত্ত্বিকের চেয়ে একটি মরমী হৃদয়  দরকার, যে হৃদয় যুক্তি থেকে ধারণায়, কল্পনা থেকে বাস্তবে অথবা অকারণ খ্যাতি থেকে সর্বার্থে আত্মমর্যাদার মূল্য বুঝবে। বিদ্যাসাগরের জন্মের দুশো বছর পরে আমাদের  এইটুকু শুভবুদ্ধির যেন উন্মেষ ঘটে।

Post a Comment

0 Comments