আপনি কি বর্ধমান জেলার বাসিন্দা? তাহলে জেনে নিন বর্ধমান শহরের অজানা কথা।
নিজের জন্মভূমিকে নিয়ে গর্ববোধ করেনা এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া বিরল।আমাদের গর্ব ততটাই বেশী হবে যত বেশী করে আমরা তার ইতিহাস জানব। আজ আমরা জানব বর্ধমানের বহু অজানা কথা। প্রাচীন কাহিনী থেকে বর্তমান বিবর্তন। তাই আপনি যদি বর্ধমান জেলার বাসিন্দা হন বা বর্ধমানের সাথে আপনার কোনরূপ সম্পর্ক জড়িয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই জেনে নিন বর্ধমান শহরের নানান অজানা কথা।
বর্ধমান সত্যই বর্ধমান
বর্ধমান কথাটি বা নামটি কবে কোথা থেকে এসেছে, সে ইতিহাস আজ পাওয়া যায় না বা সঠিকভাবে জানার উপায় নেই।অস্বিন নগর/আস্তিক নগর -ঈশ্বর পুর- শরিফাবাদ –বার-ই-দেওয়ান থেকে আজকের 'বর্ধমান' এ উত্তরণ বহু ইতিহাসের সাক্ষী। এই বর্ধমান স্থানটি যে অত্যন্ত প্রাচীন তা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।
আমরা একথা জানি যে, পূর্বে কোনও নগর বা প্রধান শহর গড়ে উঠত নদী বা সমদ্রের কিনারায়, কারণ বাণিজ্যই প্রধান আয়ের উপায়। যখন বাষ্পীয় যান, আকাশ যান ছিল না তখন জলপথই ছিল বাণিজ্যের প্রধান পথ। এই জলপথকে আশ্রয় করেই গড়ে উঠেছিল বর্ধমান নগর দামোদর নদীর তীরে। সেকালে দামোদর ছিল বর্ধমানের দক্ষিণে তো বটেই তবে আরও উত্তরদিকে। দামোদরের কোনখানেই বাঁধ ছিল না, —না বুকের ওপর, না উত্তর পাশে ; ফলে জল থাকত বারমাসই এবং সেই জলে ভেসে আসত বহু বাণিজ্যপোত। শুধু ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকেই নয়—সুদূর প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য থেকেও বাণিজ্যের পসরা নিয়ে আসত বণিকেরা এই দেশে বাণিজ্য। করবার জন্য। বর্ধমান নগর নিশ্চয়ই ছিল বর্ধমান-ভুক্তির মধ্যে, আর বর্ধমান-ভুক্তি মানেই গঙ্গা-রাঢ় দেশ। গ্রীকেরা বর্ধমান ভুক্তি আক্রমণের উদ্যোগ করেছিল এবং তাদেরই ইতিহাসে বর্ধমান বাণিজ্যের কথা উল্লেখ আছে। অনেকে জৈন ২৪শ তীর্থঙ্কর বর্ধমান স্বামীর তপস্যার স্থান বলে বর্ধমানের নাম জড়িত করেন কিন্তু সে সম্বন্ধে কোনও প্রমাণ পাওয়া যায় না। পরে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্যেই রাঢ়বঙ্গে বর্ধমান প্রসিদ্ধি লাভ করে। অবশ্য এর মূল কারণই হচ্ছে দামোদর নদ—যদিও পরবর্তীকালে এই দামোদর নদই আমাদের নানাভাবে বিপদগ্রস্ত করে তোলে-
‘ওরে নদ দামোদর
তোরে নিয়ে আতান্তর’
কিন্তু এ সম্বন্ধে সঠিক কিছু বলার সময় এখনও হয়নি। যখন দামোদরের কোন বাধ ছিল না, তখন প্রতি বৎসরে বন্যার জলে দামোদরের দু'পাশের গ্রামগুলি এমন কি বর্ধমান শহরও জলে ভরে যেত। শুধু বাড়িঘর নয় গো-মহিষের সঙ্গে মানুষও ভেসে যেত বন্যার জলে আর সেই সঙ্গে শহরের আবর্জনাও যেত পরিষ্কার হয়ে। দু-পাশের জমির উপর পড়ত পলিমাটি, যার ফলে বর্ধমান ছিল স্বাস্থ্যকর স্থান আর জমিগুলোর বর্ধিত হত উর্বরতা। এই নগরেই এসেছেন স্বাস্থ্য পরিবর্তনের জন্য বাঙলার মনীষী বিদ্যাসাগর মহাশয়, আর ধনে ধান্যে ছিল এই অঞ্চল চির-সমৃদ্ধ। বর্ধমান পৌর এলাকার দক্ষিণ প্রান্ত দামোদরের বাঁধ পর্যন্ত এবং দামোদরের দুটি প্রধান ঘাট সদরঘাট ও কাঠগোলার ঘাট এই এলাকার মধ্যে। সদরঘাট নামেই বুঝতে পারি পরে এই স্থানেই ছিল প্রধান পথ এবং বাণিজ্যেরও প্রধান কেন্দ্র। কাঠগোলার ঘাটের কাছেই কাঞ্চননগর বর্ধমান পৌর এলাকা-ভুক্ত। এই কাঞ্চননগরই কিছুদিন পূর্বে ছিল বর্ধমান নগরের প্রাণকেন্দ্র। ব্যবসা-বাণিজ্য যা কিছু সবই ছিল তখন এখানে। ইতিহাস প্রসিদ্ধ কর্ণসুবর্ণ নাকি কাঞ্চননগর। পরবর্তীকালে যখন যানবাহনের বহুল ভাবে প্রচলন হল তখন প্রধান পথের ওপর গড়ে উঠল নগর। বিখ্যাত গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড শেরশাহ নির্মিত ভারতের সর্বপ্রধান পথটি এই নগরের পূর্ব উত্তর দিয়ে চলে গেছে কলকাতা থেকে। দিল্লী শহর ক্রমেই গড়ে উঠল কাঞ্চননগর থেকে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের দিকে অর্থাৎ পূর্বে ও উত্তরে। নগরের এলাকা ক্রমেই বাড়তে লাগল। যানবাহনের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে জলপথ ছেড়ে স্থলপথে ব্যবসা-বাণিজ্য প্রচলিত হল—বিশেষ করে রেলপথ নির্মিত হলে জলপথ সবাই প্রায় বর্জন করল। বর্ধমানের সুবিধা হল—গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড আর বর্ধমান রেল স্টেশনের সংযোগ হলো শহরে। শহর গড়ে উঠল আরও ভালভাবে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের পূর্ব দিকেও নগর পরিব্যাপ্ত হল, এখনকার তো কথাই নেই। এইভাবেই সুদূর প্রাচীনকাল থেকে বর্ধমান শহরের নাম চলে আসছে, বর্ধমান সত্যই বর্ধমান।
www.unknownfacts.co.in/আরও পড়ুন- বর্ধমানের বহু অজানা তথ্য 👈
প্রাচীন ও মধ্য যুগের ইতিহাসে
বর্ধমান
পুরাণের পাতাতেও বর্ধমান-ভুক্তির
কথা আছে। পুরাণ, গ্রীক, তীর্থঙ্করের পরে এই দেশ নগরের হয়েছে উত্থানপতন, নানা ঘাত-প্রতিঘাতে
বিভিন্ন রাজশক্তির উত্থান-পতনের সঙ্গে। পাঠান মোগল যুগের ইতিহাসে বর্ধমান-ভুক্তি শুধু
নয়–বর্ধমান নগর একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। বর্ধমান-ভুক্তির আর একটি নাম ছিল
শরিফাবাদ। পাঠানেরা বঙ্গ বিজয়ের প্রথম অবস্থায় বর্ধমান জেলা অধিকার করে বঙ্গের শেষ
স্বাধীন রাজা দায়ুদ খাঁর পরিবারবর্গ বর্ধমান নগরে ধৃত হন। মোগল সম্রাট আকবর শাহের
প্রিয় অনুচর হাজি বাহরাম শেখ বর্ধমানে এসে দেহত্যাগ করেন এবং পীর বাহারাম নামে অভিহিত
হন। আকবর শাহের মৃত্যুর পর সেলিম বাদশাহ জাহাঙ্গীর হয়ে কুতুবুদ্দিনকে পাঠান বাঙলার
সুবাদার করে আর সেই সঙ্গে বর্ধমানের জায়গীরদার শের আফগানের বিবাহিত পত্নী মেহেরউন্নিসাকে
ছলে-বলে কৌশলে দিল্লীতে পাঠাবার জন্যে মোগল হারেমে। কুতুবুদ্দিন অবশ্য কৌশল করে শের
আফগানকে হত্যা করে, আর সেই সঙ্গে শের আফগানের হাতে সেও নিহত হয়। মেহেরউন্নিসাকে যেতে
হয় মোগল হারেম দিল্লীতে, তিনিই হন সম্রাজ্ঞী নুরজাহান। সাহাজাদা খুরম বিদ্রোহী হয়ে
বর্ধমান অধিকার করেন। ঔরঙ্গজেবের আদেশে সাহাজাদা আজিমুসসান বর্ধমানে শান্তি স্থাপনের
জন্য প্রাসাদ নির্মাণ করে দীর্ঘদিন বাস করে। তারই জন্যে পুরাতন-চকস্থিত জুম্মা মসজিদ
নির্মিত হয়। প্রায় এই সময় থেকে বর্ধমান শহরের নবরূপের প্রবর্তন হয় এবং সেই সঙ্গে
বর্ধমানের ইতিহাসের ধারাও পরিবর্তন হয়।
বর্ধমান রাজবংশ
বর্ধমান রাজবংশ শুধু বর্ধমান
নগরের নয় বর্ধমান জেলা, সমগ্র বঙ্গদেশ এবং ভারতবর্ষের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান
অধিকার করে আছে। বর্ধমান রাজবংশের স্থাপয়িতা সঙ্গম সিংহ বা সঙ্গমরায় খ্রিস্টীয় ষোড়শ
শতাব্দীর মাঝামাঝি পাঞ্জাব থেকে জগন্নাথ দর্শনের পথে বর্ধমান শহর দিয়ে যান এবং এই
শহর ব্যবসা করার উপযুক্ত স্থান মনে করে এই শহরের কিছুদূরে বৈকুণ্ঠপুরে বসবাস করেন এবং
ব্যবসায়ে কিছু বিষয় সম্পত্তি অর্জন করেন। তার পুত্র বন্ধুবিহারী রায় বিষয়ের অধিকারী
হন এবং তার পুত্র আবু রায় ১৬৫৭ খ্রিস্টাব্দে বর্ধমান চাকলার ফৌজদারের অধীনে বর্ধমান
নগরের রেকাবী বাজারের কোতোয়াল ও চৌধুরী নিযুক্ত হন। তার পুত্র বাবু রায় বর্ধমান পরগণা
ও অন্য তিনটি মহালের অধিকারী হয়ে বর্ধমান শহরে বাস করেন। তিনিই বর্ধমান রাজবাটীর প্রথম
প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর পুত্র ঘনশ্যাম রায় শ্যামসায়র খনন করান এবং পরে তাঁর পুত্র
কৃষ্ণরাম রায় আরও অনেক বিষয় সম্পত্তি অর্জন করেন এবং ঔরঙ্গজেব বাদশাহের কাছে বর্ধমান
পরগণার জমিদারি স্বত্ব লাভ করেন। সেই সময় তিনি কৃষ্ণসায়র খনন করান। ১৬৯৭ খ্রিস্টাব্দে
চিতুয়া বরদার জমিদার শোভা সিংহ পাঠান সর্দার রহিম খাঁর সঙ্গে মিলিত হয়ে কৃষ্ণরাম
রায়কে যুদ্ধে নিহত করেন। তাঁর পুত্র জগৎরাম রায় কৃষ্ণসায়র পুষ্করিণীতে নিহত হন।
কীর্তিচান্দ জগৎরাম রায়ের জ্যেষ্ঠ পুত্র, ইনি অনেক বিদ্রোহ দমন করে শোভা সিংহের ভ্রাতাকে
নিহত করেন। তার বিজয় গৌরব চিরস্থায়ী করবার জন্য কাঞ্চননগরের দক্ষিণে বারটি তোরণ নির্মাণ
করেন। তার একটি এখনও বর্তমান—সেই অঞ্চলই বারো-দুয়ারী নামে প্রসিদ্ধ। তাঁর পুত্র
চিত্রসেন রায় পিতার উত্তরাধিকারী হন এবং তিনি প্রথম দিল্লীর বাদশাহ আবুল ফতে নাশিরুদ্দিন
মহম্মদ শহির কাছে রাজা উপাধি লাভ করেন। তার কোনও পুত্র না থাকায় ভ্রাতুস্পুত্র তিলকচান্দ
বর্ধমানের রাজা হন এবং মহারাজাধিরাজ উপাধি লাভ করেন। এই সময়েই বর্ধমান চাকলা ইস্ট
ইন্ডিয়া কোম্পানিভুক্ত হয় এবং ইনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে খাজনা দেন। ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে মহারাজ তিলকচান্দের মৃত্যু হলে
তেজচন্দ রাজা হন। এতদিন পর্যন্ত বর্ধমানে পুলিশ আদালত সব ছিল বর্ধমান রাজের অধীনে,
কিন্তু এরই আমলে শাসন ও বিচারের ভার সম্পূর্ণরূপে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গ্রহণ করে।
তার পুত্র প্রতাপচন্দ অকালে স্বৰ্গরোহণ করেন। তেজচন্দের সময়েই শক্তি সাধক ও কবি কমলাকান্ত
বর্ধমানের কোটালহাটে আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। তেজচন্দ নির্মিত প্রাসাদেই বর্তমান মহিলা
কলেজ প্রতিষ্ঠিত। তেজচন্দ মহতাবচন্দকে দত্তক পুত্র গ্রহণ করেন এবং পরে মহতাবচন্দ রাজা
হন। মহতাবচন্দের সময়েই বর্ধমান নগরের বিশেষ উন্নতি হয় এবং এরই সময়ে বর্ধমান পৌর
প্রতিষ্ঠান হয়। মহতাবচন্দ বালক ও বালিকাদের জন্য ইংরাজি বিদ্যালয়, হাসপাতাল ও বহু
দেব মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমান। গোলাপবাগ, মহতাব মঞ্জিল তারই কীর্তি এবং
কৃষ্ণসায়র ও বিভিন্ন পথের বৃক্ষ সজ্জা তারই আমলে হয়। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়
তারই কীর্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। মহতাবচন্দ অপুত্রক থাকায় আফতাবচন্দকে দত্তক পুত্র গ্রহণ
করেন। আফতাবচন্দ বর্ধমান পৌর প্রতিষ্ঠানকে পানীয় জলের ব্যবস্থার জন্য ৫০ হাজার টাকা
দান করেন। আফতাবচন্দের মৃত্যুর পর তার কোনও সন্তান না থাকায় তার মহিষীরা বিজয়চন্দকে
দত্তক পুত্র গ্রহণ করেন। মহারাজ বিজয়চন্দ এই নগরীর প্রভূত উন্নতি করেন। বর্ধমান ফ্রেজারহাসপাতাল (বর্তমানে বিজয়চন্দ হাসপাতাল) তাঁরই প্রচেষ্টায়। কার্জন গেট নামে পরিচিত
স্টার অফ ইন্ডিয়া গেট (বিজয় তোরণ), টেকনিক্যাল স্কুল, শহরকে রক্ষার। জন্য
দামোদরের বাঁধ, মেডিকেল স্কুল, সাহিত্য পরিষদ, শ্রীরামকৃষ্ণ আশ্রম, মিউনিসিপ্যাল স্কুল
প্রভৃতি বহু জনহিতকর প্রতিষ্ঠান তারই কীর্তি। মহারাজ বিজয়চন্দের মৃত্যুর পর তার জ্যেষ্ঠ
পুত্র উদয়চন্দ বর্ধমান রাজের সিংহাসন আরোহণ করেন এবং তিনিও এই শহরের প্রভূত উন্নতি
সাধন করেন। বর্তমান রাজ কলেজ প্রাসাদ, মহিলা কলেজ এবং বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় তারই
প্রচেষ্টায় ও দানে গঠিত। বর্ধমান পৌর প্রতিষ্ঠান তথা সমগ্র বর্ধমান শহরের যাবতীয়
উন্নতির মূলে এই রাজবংশের দান চিরস্মরণীয়। বর্ধমান শহরের বহু রাস্তা মহারাজার নিজস্ব
ব্যয়ে নির্মিত, এখন অবশ্য সেগুলি পৌর প্রতিষ্ঠানের অন্তর্গত, মাত্র কয়েকটি প্রধান
পথের ভার বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় গ্রহণ করেছেন।
আরও পড়ুন- বর্ধমান রেলস্টেশনের অজানা কাহিনী 👈
বর্ধমানের দক্ষিণে দামোদর
নদ এবং তারই কিছু উত্তরে বাঁকা নদী। শহরের তথা সদর মহকুমার এই বাঁকা নদী জল নিষ্কাশনের
একমাত্র খাল। বাঁকা নদী অতিক্রম করে শহরের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে যাতায়াত করতে
হয়, সেইজন্য পৌর এলাকাভুক্ত নদীর অংশের ওপর সর্বসমেত পাঁচটি সেতু আছে, এর মধ্যে প্রধান
দুটি জি. টি. রোড এবং আলমগঞ্জ অঞ্চলে। সর্বমঙ্গলা বাড়ির নিকট সেতুটিও গুরুত্বপূর্ণ।
তবে রাজগঞ্জ মহন্তস্থলস্থিত ও কালীবাজার সন্নিহিত সেতু দুটি যানবাহন চলাচলের পক্ষে
খুব সুবিধাজনক নয়। এখানে পৌর প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণাধীনে শ্মশানঘাট ‘নির্মল ঝিল’
এই বাকার তীরেই অবস্থিত, পানীয় জলের কলও এই বাঁকার তীরে। তাছাড়া শহরের বহু ধানকল
এই বাঁকা নদীর তীরে অবস্থিত, কাজেই বাঁকা নদী বর্ধমানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ গ্রহণ
করে আছে। বর্তমানে এই বাঁকা সংস্কার করা হচ্ছেমনে হয় তাতে শহরের পয়ঃপ্রণালীর অনেক
উন্নতি হবে।
কাঞ্চননগর এই অঞ্চলের একটি
প্রধান জনপদ। বর্তমানে নানাবিধ অসুখের প্রকোপে এই অঞ্চল জনশূন্য প্রায়। কথিত আছে কাঞ্চননগরই
ইতিহাস খ্যাত কর্ণসুবর্ণগ্রাম। এখানে অনেক প্রাচীন ধবংসাবশেষ আছে। কঙ্কালী মাতার মন্দির
এবং করচা প্রণেতা মহাপ্রভুর পার্শ্বচর গোবিন্দদাসের ভিটা এই কাঞ্চননগরে। ছুরি,
কাঁচি ও ক্ষুরের জন্য কাঞ্চননগর ভারত বিখ্যাত। বর্ধমানের রাজবংশ প্রথমে কাঞ্চননগরে
বাস করতেন। কাঞ্চননগরের উত্তরে রথতলা—সেখানে বর্ধমানের মহারাজাদের প্রদত্ত দুটি বিরাট
কাঠের রথ ছিল, বর্তমানে তা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেছে। রাজগঞ্জের মহন্তস্থল বর্ধমান
মহারাজার গুরুগৃহ। এখানে বিরাট রাধাগোবিন্দ মন্দির আছে। তবে প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ দেখে
মনে হয় এককালে এইসব অঞ্চল খুবই সমৃদ্ধ ছিল।
কার্জন গেটের অজানা কথা👈 Click here
কাঞ্চননগরের পূর্বদিকে আঁজিরবাগান,
আলমগঞ্জ ও তেজগঞ্জ। তেজগঞ্জে বিখ্যাত কালীর মন্দির আছে। তারপরেই বেড়। খাজা
আনোয়ার বেড়ে সাহাজাদা আজিমুনের মন্ত্রী ও সেনাপতি খাজা আনোয়ারের কবরস্থল।
পাঠান রহিম খাঁ নানা ছলে খাজা আনোয়ারকে হত্যা করে। তাই আজিমুস্সানের পুত্র ফারোখশিয়ার
বেড়ে নবাব বাড়ি এবং খাজা আনোয়ারের ও তার চারজন অনুচরের জন্য স্মৃতি সৌধ নির্মাণ
করেন। বাঁধানো পুষ্করিণীর মধ্যে একটি কক্ষ এবং এই স্মৃতিসৌধের নির্মাণ কার্য খুবই মনোরম।
স্টেশনের কাছে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের পাশে ক্যাম্পিং গ্রাউন্ড ও পর পারে যেখানে এখন
জেলা সমাহর্তা প্রভৃতির কুঠি আছে, এই অঞ্চল জুড়ে তখন মোগল বাদশাহদের সৈন্যগণ বিশ্রাম
করত বা সময়ে সময়ে খণ্ডযুদ্ধও হয়ে গেছে।
বর্ধমান রাজবাটী প্রায় শহরের মধ্যেই অবস্থিত। এই রাজবাটীর দক্ষিণে পুরাতন
চক—এখানেই জুম্মা-মসজিদ অবস্থিত, আরও দূরে পীর বাহারাম। তুর্কির অধিবাসী
হজরৎ হাজি বহরাম শেখ মক্কায় পিপাসার্তদের জলদান করতেন। তিনি ভারতবর্ষে এসে বাদশাহ
আকবরের সখ্যতা অর্জন করেন। কিন্তু আকবরের সভাসদ আবুল ফজল ও ফৈজীর চক্রান্তে দিল্লী
পরিত্যাগ করে বর্ধমানে আসেন। বর্ধমানে তখন যোগী জয়পাল বলে একজন সাধু ছিলেন। জয়পাল
বহরাম শেখের অলৌকিক ক্ষমতায় আকৃষ্ট হয়ে তাকে গুরুপদে বরণ করেন। কিন্তু মাত্র তিনদিন
পরেই তার মৃত্যু হয়। সম্রাট শেখ সাহেবের জন্যে অনুচর পাঠান। কিন্তু পরে যখন জানতে
পারেন শেখ জীবিত নাই, তখন তার স্মৃতিসৌধ নির্মাণের ব্যবস্থা করেন। এই স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণে
আরও দুজনের স্মৃতি প্রতিষ্ঠিত। ভারত সম্রাজ্ঞী
নূরজাহানের প্রথম স্বামী শের আফগান ছিলেন বর্ধমানের জায়গীরদার। কুমারী অবস্থায় তিনি
দিল্লীতে মোগল হারেমে মেহেরউন্নিসা নামে পিরচিত ছিলেন এবং তৎকালীন সাহাজাদা সেলিমের
সুনজরে পড়েছিলেন। কিন্তু আকবর মেহেরের সঙ্গে সেলিমের বিবাহ দিতে সম্মত হননি। পরবর্তীকালে
আকবরের মৃত্যুর পর সেলিম জাহাঙ্গীর নাম নিয়ে সম্রাট হলেন এবং মেহেরের স্বামীকে যে
কোন প্রকারে নিহত করে মেহেরকে দিল্লীর হারেমে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করবার জন্য পাঠালেন
কুতুবুদ্দিনকে বাঙলার সুবাদার করে। অন্যায় যুদ্ধে শের আফগান এবং কুতুবুদ্দিন
উভয়েই নিহত হলেন, মেহেরউন্নিসা গেলেন দিল্লীতে সম্রাজ্ঞী নূরজাহান হয়ে, আর পীর বাহারামের
আশ্রয়ে চির-সমাধি লাভ করলেন পাপিষ্ঠ কুতুবুদ্দিনের সঙ্গে মহান বীর শের আফগান। রাজবাড়ির
পশ্চিম অঞ্চল আগে রাধাগঞ্জ নামে খ্যাত ছিল। এই অঞ্চলেই ছিল বর্ধমান রাজের সৈন্য-সামন্তের
প্রাসাদ, তার চিহ্ন এখনও আছে নতুনগঞ্জের দোকান ঘরগুলি। নতুনগঞ্জই এখন ব্যবসা-বাণিজ্যের
প্রাণকেন্দ্র।
আরও পড়ুন- শক্তিগড়ের ল্যাংচা কেন বিখ্যাত? মিস্টির এরকম নামকরণ হল কেন? 👈Click here
সর্মঙ্গলা দেবী এই শহরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। অদূরে বর্ধমান-রাজ প্রতিষ্ঠিত
১০৯টি শিব মন্দির এবং আরও কাছে বর্ধমান মহারাজ বিজয়চন্দ প্রতিষ্ঠিত বিজয়ানন্দ
বিহার আজ ধ্বংস পথে। এই শহর পবিত্র করেছেন অতীতে মহাপ্রভু শ্রীগৌরাঙ্গ যাঁর প্রেমের
আহ্বানে কাঞ্চননগরের গোবিন্দ দাস গৃহত্যাগ করে দীর্ঘদিন মহাপ্রভুর পার্শ্বচররূপে থেকে
‘গোবিন্দ দাসের করচা’ একটি অমূল্য সম্পদ দিয়ে গেছেন। আরও কিছুদিন পরে পরম-পুরুষ
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ একবার কামারপুকুর থেকে বর্ধমান স্টেশন হয়ে। দক্ষিণেশ্বর যাবার
পথে এই শহরের শ্যামসায়রের পূর্ব পাড়ে যেখানে শ্রীরামকৃষ্ণ আশ্রম অবস্থিত ঐ
অঞ্চলে অবস্থান করেছেন এবং সমাধিস্থ হয়েছিলেন। আরও কত মনীষী এই শহরকে পবিত্র করেছেন
বিভিন্ন সময়ে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য—বিদ্যাসাগর মহাশয়, মাইকেল মধুসূদন, শ্রীমা,
ভূদেব মুখোপাধ্যায়, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ প্রভৃতি। আজও এই শহর তথা এই জেলার ইতিহাস
রচিত হয়নি। এ খুবই দুঃখের কথা। ইতিহাস একটি জাতির মহৎ সম্মানের পরিচয়। যার ইতিহাস
নেই তার কোনও সংস্কৃতি নেই।এই জেলার অনেক মহাগুণী ঐতিহাসিক ও সাহিত্যিক আছেন। তাঁদের
কাছে আমাদের আবেদন অচিরে এই জেলার একটি ইতিহাস রচনা করবার তারা ব্যবস্থা করুন। কারণ
ইতিহাস রচনার যত বিলম্ব হবে অনেক জিনিস ততই বিলুপ্ত হবে।
0 Comments